
বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর বর্জ্য অপসারণ, বর্জ্য রিসাইক্লিং ও কম দূষণের মাধ্যমে বর্জ্য পোড়ানো কিংবা ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বর্জ্য সংগ্রহ করে জনবসতি থেকে দূরবর্তী কোনো স্থানে তা জমা করে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পুঁতে ফেলা, পুড়িয়ে ফেলা বা রূপান্তর করা এখনও এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয়বহুল, জটিল এবং ব্যর্থতাপূর্ণ কার্যক্রম হিসেবে বহাল রয়ে গেছে। অথচ বর্তমান উন্নত বিশ্বে এই দায়িত্ব অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব উপায়ে সম্পন্ন করার প্রযুক্তি প্রয়োগের নজির যত্রতত্র। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নানা ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি এখন সুলভে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা যায়।
বর্জ্য রিসাইক্লিং এখন অনেক দেশে পরিবেশ সুরক্ষায় অন্যতম ডাইমেনশন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে, যার অন্যতম প্রক্রিয়া হলো বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। আধুনিক চুল্লির মাধ্যমে বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে পরিবেশ বিপর্যয় অনেকখানি কমানো যায়। 'বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ'- এ দেশে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রায়ই উচ্চারিত হয়। অথচ দুঃখজনক, স্বাধীনতার ৫১ বছর এবং ১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার ৩১ বছর পার হওয়ার পরও দেশে 'বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ' প্রকল্প একটিও চালু হলো না।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এ ব্যাপারে ১৯৯৪ সাল থেকে কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও ফলাফল শূন্য। আমার জানামতে, চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এ ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়েছিলেন। কিন্তু নব্বই দশকে এ-সম্পর্কিত তাঁর প্রকল্প প্রস্তাবটি তদানীন্তন বিএনপি সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। আরও দুঃখজনক, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সংসদীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকারে আসীন হলেও চট্টগ্রাম বন্দরে মার্কিন কোম্পানি স্টিভেডরিং সার্ভিসেস অব আমেরিকাকে (এসএসএ) ঠিকাদারি প্রদানের ইস্যু নিয়ে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে সরকারের শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্ভবত এ কারণে অন্য অনেক চসিক প্রকল্পের মতো বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প প্রস্তাবটি সরকারের সুনজর পেতে ব্যর্থ হয়। আবার ২০০১ সালে সরকারে ক্ষমতাসীন হয় বিএনপি-জামায়াত জোট। অতএব, ২০০১-০৬ মেয়াদে আবারও চসিক তাদের রোষানলে পড়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী তৃতীয় মেয়াদে মেয়র থাকার কারণে।
২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। ওই সরকারের আমলে তিনি আর মুক্তি পাননি। অতএব, ওই আমলেও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পটি কোল্ড স্টোরেজে থেকে যায়। ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন তখনও মহিউদ্দিন চৌধুরী চসিক মেয়র ছিলেন। তখন প্রকল্পটি নিয়ে সরকারের কিছুটা নড়াচড়া দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ২০১০ সালে মেয়র নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মনজুর আলম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে মেয়র হয়ে বসেন, তখন বোধগম্য কারণেই চসিক আবার মহাজোট সরকারের কোপদৃষ্টিতে পড়ে। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হলেও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন তাঁর অগ্রাধিকার পেতে সমর্থ হয়নি (হয়তো মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রিয় প্রকল্প ছিল বলে তিনি এটিকে এগিয়ে নেননি! বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়াদেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়)।
দেশের অন্য কোথাও বর্তমান সরকারের আমলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন যথাযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। হয়তো বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ এবং কয়লা ও গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মেগা প্রকল্পগুলো অনেক কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে ভেবে সরকারপ্রধানের নজর 'বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ'- এই ছোট ইস্যুতে ফিরে আসেনি! কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশের ১০টি সিটি করপোরেশনের প্রতিটিতে একটি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট প্রতিষ্ঠা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিক থেকে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে।
দেশের আরেকটি দুঃখজনক অবহেলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌরবিদ্যুতের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। ২০২০ সালের মধ্যেই ভিয়েতনাম বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে। অথচ বাংলাদেশের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন এখনও এক হাজার মেগাওয়াটের নিচে রয়ে গেছে। ভিয়েতনামের সোলার এনার্জি উৎপাদনে এই অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জনের খবরটি চোখে আঙুল দিয়ে বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে সোলার এনার্জিকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিলে বাংলাদেশও অদূর ভবিষ্যতে এলএনজি-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে সুলভে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো প্রধানত প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের রিজার্ভ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই এলএনজি আমদানি গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে। এলএনজির আন্তর্জাতিক দামের নাটকীয় উল্লম্ম্ফন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে ইতোমধ্যে বড় ধরনের সংকটে ফেলেছে। ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে দেশে প্রতিদিন দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লোডশেডিং করা হচ্ছে। ডিসেম্বরের শীতকালেও লোডশেডিং থেকে দেশবাসী নিস্কৃতি পাচ্ছে না।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের এই জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভরতা থেকে নিস্কৃতি পেতে হলে ভিয়েতনামের ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ারের সাফল্য কীভাবে অর্জিত হয়েছে, তা সরেজমিন দেখে এ দেশের সোলার পাওয়ার নীতিকে অবিলম্বে ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের বড় বড় নগর ও মফস্বল শহরে প্রাইভেট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ির ছাদ ব্যবহারের মাধ্যমে ৫ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন মোটেও অসম্ভব মনে হচ্ছে না। প্রয়োজন হবে সোলার প্যানেল ও ব্যাটারির ভর্তুকি-দাম কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং যুগোপযোগী 'নেট মিটারিং' পদ্ধতি চালু করা। সম্প্রতি নেট মিটারিং সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর এনার্জি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর একটি টিভি বিজ্ঞাপন দেখে স্রেডার ওয়েবসাইটে খোঁজ নিয়ে নিজের বসতবাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপনের উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওখানে কোনো নির্দেশনাই পাওয়া যায়নি। ভিয়েতনাম ছাড়াও গণচীন, থাইল্যান্ড, ভারত ও জার্মানি ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে। এই 'নেট-মিটারিং' প্রযুক্তি গণচীন থেকে এখন সুলভে আমদানি করা যাচ্ছে। অথচ এ ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি একেবারেই নগণ্য রয়ে গেল কেন?
সৌরবিদ্যুৎ সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব এবং ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু এই প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলে কায়েমি স্বার্থের পুঁজি লুণ্ঠন খুব জমজমাট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে জন্যই হয়তো দেশের ক্ষমতাসীন মহলে এই জনবান্ধব প্রযুক্তিটির উৎসাহী প্রমোটার পাওয়া যাচ্ছে না! সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যে গণচীন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি ৭ টাকার নিচে নেমে এসেছে। এর মানে, এলএনজির সাম্প্রতিক নাটকীয় দাম বাড়ার আগেই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের চেয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে গিয়েছিল। এলএনজির দামে উল্লম্ম্ফনের পর এখন তো সৌরবিদ্যুৎ তুলনামূলক আরও সস্তা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকে নির্দি্বধায় দেশের বিদ্যুৎ খাতে অগ্রাধিকার প্রদান করুন। ২০২১ সালে দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধায় নিয়ে এসে আপনি যে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছেন, সেটি টেকসই করার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌরবিদ্যুৎকে প্রধান উৎসে পরিণত করা সময়ের দাবি।
ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন