- মতামত
- শাইলক
শাইলক
বিশ্ববাজারে মূল্যহ্রাসের সহিত সংগতি রাখিয়া সয়াবিন তৈলের মূল্য লিটারপ্রতি ৫ টাকা এবং পাম অয়েলের মূল্য লিটারপ্রতি ৪ টাকা হ্রাস করিয়া বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটা প্রজ্ঞাপন জারি করিয়াছে। শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে আগামী রবিবার হইতে দেশের সর্বত্র বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন বিক্রয় হইবে ১৯২ টাকায়; এক লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রয় হইবে ১৭২ টাকায় এবং এক লিটার পাম অয়েল বিক্রয় হইবে ১১৭ টাকায়। এই দেশে কোনো একটা পণ্যের মূল্য একবার ঊর্ধ্বমুখী হইলে সাধারণত উহা নিম্নমুখী হয় না। সেই দিক হইতে ভোজ্যতৈলের মূল্যহ্রাস সম্পর্কিত সরকারের এহেন সিদ্ধান্তে ক্রেতাসাধারণের আনন্দিত হইবার কথা। কিন্তু কিঞ্চিৎ বিস্ময়কর শোনাইলেও বলিতে হয়, সাধারণ মানুষ বরং সরকারের এ রূপ সিদ্ধান্ত কার্যকর হইবার ব্যাপারেই সংশয় প্রকাশ করিতেছেন। তাঁহাদের জিজ্ঞাসা- যে কোনো নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বরাবর তৎক্ষণাৎ কার্যকর হইলেও ভোজ্যতৈলের মূল্যহ্রাসের সিদ্ধান্তটি কার্যকরে তিন দিন বিলম্ব কেন? আমাদের স্মরণে আছে, বিশ্ববাজারে মূল্য হ্রাস পাইবার কারণে গত ১৭ জুলাই বোতলজাত সয়াবিন তৈলের মূল্য প্রতি লিটার ১৪ টাকা কমাইয়া ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হইয়াছিল। কিন্তু উক্ত মূল্যে কোথাও বাঙালির রসুইঘরের অপরিহার্য দ্রব্যটি ক্রয় করা যায় নাই। বিগত অক্টোবরের সূচনায়ও বিশ্ববাজারের সহিত তাল মিলাইয়া একই পণ্যের মূল্য অভ্যন্তরীণ বাজারে ১৪ টাকা হ্রাস করা হইয়াছিল। হতাশাজনকভাবে, তখন বাজার হইতে বোতলজাত সয়াবিনই উধাও হইয়া গিয়াছিল। তবে কয়েক দিবসের মধ্যেই তৈল ব্যবসায়ীদের দাবি মানিয়া যখন বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য লিটারপ্রতি ১২ টাকা বৃদ্ধি করা হইল, পুনরায় বাজারে পণ্যটির সরবরাহ প্রায় স্বাভাবিক হইয়া গেল। এইবারও যে উহার পুনরাবৃত্তি হইবে না- সেই গ্যারান্টি কে দিবে?
প্রশ্নটা উত্থাপনের কারণ হইল, অন্তত ভোজ্যতৈল বিষয়ে সরকারকে আমরা বরাবরই মিল মালিকদের মন জোগাইয়া চলিতে দেখিয়াছি। মিল মালিক বলিতে আমরা অপরিশোধিত ভোজ্যতৈল বিদেশ হইতে আমদানির পর নিজস্ব কলে পরিশোধন করিয়া যাহারা দেশের পাইকারদের নিকট বিক্রয় করে, তাহাদের কথা বলিতেছি। তাহাদের সংখ্যা একেবারেই মুষ্টিমেয়। তাই নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করিয়া ভোজ্যতৈলের বাজার নিয়ন্ত্রণ তাহাদের পক্ষে কঠিন কিছু নহে। এই সুযোগের অপব্যবহার করিয়াই উহারা গত দুই বৎসরের অধিক সময় ধরিয়া ভোক্তাসাধারণের পকেট কাটিয়া চলিয়াছে। বলা বাহুল্য, ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বাজারে ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিলিত ৫০৫ হইতে ৫১৫ টাকায়, যাহা এখন ক্রয় করিতে হইতেছে ৯২৫ টাকায়- প্রায় দুইগুণ মূল্যে। অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে পণ্যটির মূল্য গত জুন মাসে টনপ্রতি ১৭০০ ডলার অতিক্রম করিলেও আগস্টে ১৪৩৪ ডলারে নামিয়া আসে। গত দুই মাসে সয়াবিনের মূল্য বিশ্ববাজারে আরও হ্রাস পাইয়াছে বলিয়া বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। কিন্তু উহার সহিত সংগতি রাখিয়া ভোক্তা পর্যায়ে সয়াবিনের মূল্য হ্রাস করা হয় নাই।
অনেকে বলিতেছেন, দেশে বিশেষ করিয়া ভোজ্যতৈলসহ ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা যে রকম মুনাফাগৃধ্নুতা প্রদর্শন করিতেছেন, তাহাতে তাহাদের শেকসপিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিসের শাইলকের সহিত তুলনা করিলে ভুল হইবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হইল, দেশে ভোক্তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রহিয়াছে; ব্যবসায়ীদের মধ্যে সকল পর্যায়ে মজুতদারি বা সিন্ডিকেশন প্রতিরোধে প্রতিযোগিতা কমিশনও দৃশ্যমান। কিন্তু ইহাদের কাউকেই অদ্যাবধি ঐ শাইলকরূপী ভোজ্যতৈল ব্যবসায়ীদের নেতিবাচক প্রবণতার বিরুদ্ধে সক্রিয় হইতে দেখা যায় নাই। উদ্বেগের বিষয়, ভোজ্যতৈলসহ ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা যদি স্বেচ্ছাচার চালাইতেই থাকে, আর সরকার পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধির সকল দায় বিশ্ববাজারের উপর চাপাইয়া এক রূপ নির্বিকার রহিয়া যায়, তাহা হইলে বাজারে এক ধরনের অরাজকতা নামিয়া আসিবে, যাহা কোনোক্রমেই কাম্য হইতে পারে না। আমাদের প্রত্যাশা, যে কোনো প্রকারে হউক সরকার ভোগ্যপণ্যের বাজারে উহার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিবে এবং ভোক্তাসাধারণকে- ইতোমধ্যে যাহাদের কারণে অধিকাংশের প্রকৃত আয় হ্রাস পাওয়ায় সংসার চালানোই দুরূহ হইয়া পড়িয়াছে; সামান্য হইলেও স্বস্তি দিবে। আর সরকার যে এতদ্বিষয়ে আন্তরিক- উহার স্বাক্ষরস্বরূপ ভোজ্যতৈলের মূল্য বিষয়ে সর্বশেষ গৃহীত সিদ্ধান্ত কার্যকর করিবে।
মন্তব্য করুন