যতটুকু জ্বালানি শোষণ করে, তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্‌গিরণ করে- এমন একটি পরমাণু ফিউশন বা মিশ্রণ তৈরিতে গবেষকদের সাফল্যের খবর পড়ে গত সপ্তাহে অনেকে আশ্বস্ত হতেই পারেন। প্রায় অর্ধশতাব্দীর সাংবাদিকতাকালে আমি দেখেছি, কোনো দশকই বিজ্ঞানীদের এমন দুই-তিনটি ঘোষণা ছাড়া শেষ হয়নি। প্রায় প্রতিবারই তাঁরা দাবি করেছেন, তাঁদের আবিস্কারের মধ্য দিয়ে সূর্যের ভূমিকা পুনঃসৃজন করতে পারবে বিজ্ঞান। গবেষণার ফলস্বরূপ যে দূষণমুক্ত ও সুলভ পরমাণু ফিউশন উৎপাদন হবে, তা আমাদের জীবন পরিবর্তন করে দেবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখন এ ধরনের ঘোষণা বিরল হয়ে আসছিল, আমার মধ্যে প্রত্যাশার উষ্ণতা জেগেছিল যে, আমরা একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে ফিরছি।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটি-এনআইএফ তাদের গবেষণা ফল প্রকাশ করল। এতে তারা এমন তাপমাত্রা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে, যা শুধু নক্ষত্র কিংবা থার্মোনিউক্লিয়ার বোমার অভ্যন্তরে পাওয়া যায়। এটা নিশ্চয় এক মাইলফলক, কিন্তু কোনোভাবে বিরাট কিছু নয়। তাতে অবশ্য মার্কিন সরকার এবং বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের শোরগোল তোলায় কোনো অসুবিধা হয়নি। বিবিসির মতো সংবাদমাধ্যম স্বর মোটা করে বলছে, গবেষকরা নিউক্লিয়ার ফিউশনে পৌঁছার ক্ষেত্রে 'একটি বড় বাধা উতরে গেছেন।' ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো সংবাদমাধ্যম এ অর্জনকে 'বিরাট সাফল্য' আখ্যা দিয়ে বলছে, এর মধ্য দিয়ে দূষণমুক্ত, সুলভ জ্বালানির নতুন যুগ সূচিত হতে পারে।
এটা নিশ্চিতভাবেই ঠিক, পরমাণু ফিউশন আমাদের এই গ্রহের জন্য অনেক সুবিধা বয়ে আনবে। এর মধ্য দিয়ে উচ্চমাত্রার কার্বন উদ্‌গিরণ ছাড়াই বিপুল মাত্রায় জ্বালানি উৎপাদন সম্ভব হবে। আর তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই নিঃসন্দেহে নতুন গতি পাবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এর আগেও অনেকবার আমরা এ ধরনের আবিস্কারের দাবি উপস্থাপন হতে দেখেছি। ১৯৫৮ সালে স্যার জন কোক্রোফট দাবি করেছিলেন, তাঁর 'জেটা ফিউশন' প্রকল্প বিশ্বকে 'অপরিমিত জ্বালানি সরবরাহ' দিয়ে যেতে পারবে। বাস্তবে সেটা ঘটেনি। ১৯৮৯ সালে মার্টিন ফ্লেকম্যান ও স্ট্যানলি পোনস ঘোষণা করেছিলেন, সাধারণ গবেষণাগার যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে তাঁরা ফিউশন তৈরির গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। ওই গবেষণা বিশ্বজুড়ে সংবাদ শিরোনাম তৈরি করেছিল; কিন্তু গবেষণাগারের বাইরে আর কোথাও তার প্রসার ঘটতে দেখা যায়নি।
এ তালিকায় ফ্রান্সে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টর-আইটিইআরের অতিকায় স্থাপনাটিও যুক্ত হতে পারে। ওই সংস্থার পক্ষে ২০২৩ সালের মধ্যে এই ফিউশন অর্জন করার কথা ছিল। কিন্তু তারা এখনও নির্ধারিত সূচির তুলনায় ১০ বছর পিছিয়ে রয়েছে এবং শত শত কোটি টাকার বাজেট বৃদ্ধি ঘটে চলেছে।
এগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রে ধারণা করা হয়েছিল, বাণিজ্যিকভাবে নির্ভরযোগ্য প্রথম পরমাণু ফিউশন স্থাপনার বিষয়টি এক বা দুই দশক দূরে মাত্র এবং সেটা সম্ভব হলেই আমাদের জীবন পাল্টে যাবে। সেসব প্রত্যাশা কখনোই বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। বরং হ্যাকার বা বিজ্ঞানীদের মধ্যে পাগলামি ছড়িয়ে পড়ার পথই খুলে গেছে। এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে একটি কৌতুকের জন্ম হয়েছে মাত্র- পরমাণু ফিউশন সব সময় গবেষণা সাফল্যের দাবি থেকে ৩০ বছর দূরে অবস্থান করে।
মার্কিন জ্বালানি সেক্রেটারি জেনিফার গ্রাহোলমের অবস্থানের পক্ষে এই দাবি বেমানান- এনআইএফের গবেষণাটি 'একুশ শতকের সবচেয়ে মুগ্ধকর বৈজ্ঞানিক অর্জনগুলোর একটি।' যে শতক ইতোমধ্যে বোসন কণা, কভিড ভ্যাকসিন, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ, মানব জিন আবিস্কার দেখে ফেলেছে; তার কাছে এ দাবি প্রমাণ করা কঠিনই বটে। এগুলোর তুলনায় এনআইএফের এ গবেষণা সাফল্য দ্বিতীয় সারির বিষয় ছাড়া কিছু নয়।
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এনআইএফ প্রযোজিত 'বিরাট সাফল্য' নিয়ে অতি শোরগোলে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছেন, পরমাণু ফিউশনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে গেছে। এটাও জোর দিয়ে বলছেন, গন্তব্য এখনও অনেক দূরে। এই সাফল্যকে এমন 'রক্ষাকর্তা' হিসেবে নেওয়া উচিত হবে না যে, এটা এখনই বিদ্যমান তীব্র জ্বালানি সংকট থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারে। যদিও গত সপ্তাহ থেকে এর সবই দাবি করা হয়ে গেছে।
দুর্ভাগ্যবশত মানব জাতি এমন এক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভয়ানক নির্ভরতা শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উল্লম্ম্ফনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। এর পরিণতি যা হবে, তার মধ্যে রয়েছে ঘন ঘন বন্যা, দাবানল, ভয়ানকতর ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নতুন নতুন রোগ ছড়িয়ে পড়া এবং বরফ টোপরগুলোর গলন।
সব মিলিয়ে বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত- বিশ্বকে রক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝে ফিউশন জ্বালানি এসে হাজির হবে না। পরমাণু ফিউশনের বাণিজ্যিক সাফল্যের ক্ষেত্রে বর্তমানে দুটি প্রধান পথ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে তীব্র তাপযুক্ত প্লাজমাকে শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে ফেলা। ফ্রান্সভিত্তিক আইটিইআর ঠিক এ পথটিই বেছে নিয়েছে। আরেকটি পথ বেছে নিয়েছে এনআইএফ- বোমার শক্তি হিলিয়ামে ফিউজ বা দ্রবীভূত করা। উভয় ক্ষেত্রেই ১০০ মিলিয়ন সেলসিয়াসের বেশি তাপ উদ্‌গিরণ ঘটতে পারে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে বড় মাথাব্যথা হচ্ছে, এই তীব্র তাপ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
অতএব, পরমাণু ফিউশন এখনও দীর্ঘ অপেক্ষাধীন প্রযুক্তির বিষয়। প্রয়োজন হবে বিপুল বিনিয়োগ ও ধৈর্যের। বিল গেটসের মতো কিছু উদ্যোক্তা সাম্প্রতিক সময়ে এদিকে মনোযোগ দেওয়ায় সেই প্রত্যাশা গতি পেয়েছে। আশা করা যায়, পরমাণু ফিউশনের বাণিজ্যিক স্থাপনার সম্ভাবনা এক দিন বাস্তবে রূপ নেবে। কিন্তু সেসব এখনও ভবিষ্যতের ব্যাপার।
এনআইএফ যে 'সাফল্য' পেয়েছে, সেটাকে নিশ্চয় স্বাগত জানাতে হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত থাকতে হবে- পরমাণু ফিউশনের শোরগোল দেখে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষার উচ্ছ্বাস প্রকাশ এখনই উচিত হবে না।
রবিন ম্যাককিয়ে :রবিবাসরীয় ব্রিটিশ দৈনিক দ্য অবজারভারের পরিবেশ সম্পাদক; ঈষৎ সংক্ষেপে ভাষান্তর শেখ রোকন