আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই চলে আসছে বাঙালি আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে রাজনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। এর সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম আর সব ধর্মের সমান অধিকার নিয়ে যে সাংবিধানিক জগাখিচুড়ি পাকানো আছে, তারও আজ পর্যন্ত সমাধান হয়নি। এমন সাংবিধানিক আইনীকরণের কারণে স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি তথা মুসলমানরা খুশি। অন্যদিকে, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যলঘুরা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করে। দুঃখজনকভাবে, এ দুই প্রশ্নের সাংবিধানিক সমাধান না করে, স্রেফ ক্ষমতায় যাওয়া বা টিকে থাকার জন্য ভোটের হিসাবকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দশকের পর দশক।
এদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধু ধর্মীয় আর নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়গুলো সংখ্যালঘুর দাবি নিয়ে কথা বলে। এ জন্য বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক আর নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তাদের মতো আন্দোলন চালিয়ে আসছে; তবে তা মূলত প্রতিক্রিয়াধর্মী অর্থাৎ শুধু ঘটনা ঘটার পর জ্বলে ওঠে। তাই যা সংখ্যাগুরুকেন্দ্রিক রাজনীতির; যাকে রাজনীতির ভাষায় মেজরিটারিয়ানিজম বা সংখ্যাগুরুবাদ বলা হয়; বিপরীতে সোচ্চার হওয়ার মূল বিষয়- সংখ্যাগুরুদের (যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাবান) নিষ্পেষণ থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপদ করা তথা সমতার শাসন কায়েম করা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
এ তো গেল ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুর কথা। দেশে আরেক ধরনের সংখ্যালঘু আছে, যাদের বলা যেতে পারে রাজনৈতিক সংখ্যালঘু। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সংখ্যাগুরুত্বের রাজনীতিই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চর্চিত হয়েছে স্বাধীনতা পর থেকে। সংখ্যাতত্ত্ব থেকে বেরিয়ে এখানকার রাজনৈতিক অঙ্গনে স্রেফ রাষ্ট্রক্ষমতার নিরিখে দুটো ভাগ করা হয়েছে- 'ক্ষমতাসীন' আর 'ক্ষমতাহীন'। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসীনরাই হয়েছে সংখ্যাগুরু। তাদের প্রকৃত সংখ্যা এবার যত কমই হোক না কেন, অন্যদিকে ক্ষমতাহীনরা হয়েছে সংখ্যালঘু; যদিও অনেক সময় তাদের পক্ষেই বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন দেখা যায়। যে দল যখন ক্ষমতায় গেছে, তখন নিজেরাই এক ধরনের 'দলীয় জাতি' গঠন করে পুরো রাষ্ট্রের ওপর তার আধিপত্য কায়েম করে। সংসদীয় গণতন্ত্রে একটা কথা বলা হয় 'উইনার টেকস অল'। অর্থাৎ বিজয়ীরা সব নিয়ে নেয়। তবে উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের এই সর্বগ্রাসী প্রবণতা ঠেকানো হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি এই প্রবাদের আক্ষরিক অর্থ প্রতিষ্ঠা করেছে।
ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি- এগুলোর চেয়ে এখানে অনেক মানুষের কাছে শুধু দলীয় পরিচয়ই টিকে থাকার প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকরি, ব্যবসা, আইনি-বেআইনি সুযোগ-সুবিধা; রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব- সবকিছু চলে যায় ক্ষমতাসীন 'দলীয় জাতি'র হাতে। রাষ্ট্রীয় খরচে নির্মিত জাতীয় বা আঞ্চলিক স্থাপনার নামকরণ হয় নিছক দলীয় বিবেচনায়। দলীয় এজেন্ডার অনুষ্ঠান তৈরি করে রাষ্ট্রীয় খরচে তা প্রচারিত হয়। এখানে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গী হতে পারলে কী না জোটে কপালে! ক্ষমতাসীন দলের বাইরের সবাই হয়ে যায় এক ব্রাত্য জাত; শুধুই আমজনতা, যাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যা মন চায় তা-ই করা যায়। এর ব্যত্যয় স্বাধীনতার পর থেকে এখনও দেখা যায়নি। এ দেশে ধর্মকর্মের চেয়ে দলবাজিই বেশি।
ক্ষমতাসীন দলের বাইরের কেউ হলে কারণে-অকারণে তাকে পস্তাতে হয়। ক্ষমতার মানচিত্রের বাইরে গেলে ন্যায্য পাওনাও অনাদায়ী হয়ে যায়। এমনকি অনেককে দেশও ছাড়তে হয়। গত ৫১ বছরে যত ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু মানুষ দেশান্তরিত হয়েছে; বিরোধী রাজনীতি করা বা ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ার কারণে দেশছাড়া মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে কম নয়। ক্ষমতার পালাবদলের ব্যবস্থার সঙ্গে তাই তো 'সেফ এক্সিট'-এর আলোচনা এখন রাজনীতিতে। ক্ষমতা ছাড়লে যেন দেশও ছাড়তে হবে। দেশের মালিক যেন শুধু ক্ষমতাসীনরাই। শুধু দেশ ছাড়া কেন- চাকরি, ব্যবসা সবকিছুই হারানো লাগতে পারে শুধু ক্ষমতাসীনদের বিরোধী হওয়ার কারণে বা বিপরীতে চিন্তা করার কারণে। তাই এ দেশে সরকারি কর্মচারীরাও যাবতীয় নিয়ম বা বিধি লঙ্ঘন করে এটাই জাহির করতে ব্যস্ত থাকে- তার অতীত এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কতটা জড়িয়ে ছিল ও আছে।
এখানে সবাই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হতে চায়। বাঙালি বা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চেয়ে বা ধর্মীয়/নৃতাত্ত্বিক দর্শন বা বৈশিষ্ট্যের চেয়ে 'দলীয় জাতীয়তা'ই আজ সবকিছুর মূল শক্তি। 'জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস'- এর পরিবর্তে কায়েম হয়েছে 'ক্ষমতাসীন দলীয় লোকেরাই সকল ক্ষমতার উৎস'। আইনের শাসনের পরিবর্তে চলে দলীয় আর ব্যক্তির শাসন। সমগ্র দেশই যেন হয়ে যায় এক 'দলীয় জাতি'র অধীন। তাই তো ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সবাই দল পাল্টাতে চায়। পুরোনো 'দলীয় জাতীয়তা' মুছে নয়া 'দলীয় জাতীয়তা' বরণ করতে চায়। সাধারণ জনগণ বা বিরোধী রাজনীতির পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চায় না অনেকেই; যেন বাঁচা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল এবং তার নেতৃত্ব এতটাই এখানে শক্তিশালী যে, তারা সাধারণ আইনের চেয়ে বেশি সংবিধান সংশোধন করে। যেখানে সংবিধান অনুযায়ী সরকার বা পুরো দেশ পরিচালিত হওয়ার কথা, সেখানে সংবিধানকেই যেন পরিচালিত করে ক্ষমতাসীন দল আর তার অনুসারীরা। তাই তো সরকারের প্রধান কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের দলীয় পরিচয় ছেড়ে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় নেতা হতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হন।
সময়ের পরিক্রমায় ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর চেয়ে দলীয় পরিচয়ই আজ এ দেশে মুখ্য। বাঙালি আর বাংলাদেশি জাতীয়তার বিতর্ক আজ বাস্তব ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে পড়েছে। দলীয় পরিচয় ছাড়া যেন বেঁচে থাকার উপায় নেই। তাই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক জগৎ- সবখানেই দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান- কোনো ক্ষেত্রই বাদ নেই। সর্বত্র দলীয় পরিচয়ের ছড়াছড়ি। শ্রমিক, কৃষক, জেলে, তাঁতি, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, ধর্মীয় গোষ্ঠী, নায়ক, গায়ক, শিল্পী- কার নেই দলীয় জাতীয়তার পরিচয়! এই পরিচয় আজ এতই শক্তিশালী যে, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশই এক সময় অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।
এম আর ইসলাম :শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়