প্রতিদিন স্মরণকালের চেয়ে বেশি যানজট হচ্ছে। রোববার সন্ধ্যায় এ যানজট এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল; মগবাজার থেকে ধানমন্ডিতে ফিরতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লেগেছিল। কিন্তু গাড়িতে শুক্রবার সকালে এ সময় ৮-১০ মিনিট লাগে। নগরের ট্রাফিক ব্যবস্থাও শিথিল থাকে।
১৭ তারিখ শনিবার আমাদের 'নীল দর্পণ' নাটকের প্রদর্শনী ছিল। টিকিট সংগ্রহ করা দর্শকরাও সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমিতে পৌঁছাতে পারেননি। সপ্তাহের দিনগুলোতে এবং শুক্র ও শনিবার বিকেলে যানজট পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ আকারে রূপ নিচ্ছে। রোববার তো রীতিমতো বাস, সিএনজি বা উবার ত্যাগ করে মানুষ হাঁটতে শুরু করেছিল যার যার গন্তব্যের উদ্দেশে। এক মোটরসাইকেল আরোহীকে বলতে শুনলাম- আজ আর বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ দেখা হবে না। বাড়ি গিয়ে ফলাফলটা দেখব। অবশ্য সে খেলাটি এত বিলম্বিত হয়েছে, তারা হয়তো টাইব্রেকার দেখতে পেরেছিলেন।
এ কথা নগরবাসীর বোধের অগম্য- কেন ট্রাফিক সিগন্যাল কিছুতেই ফিরে আসছে না? অসুবিধাটা কোথায়? ২০২২ সালে পৃথিবীতে কোন মেট্রোপলিটন শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আদিম ব্যবস্থা চালু রয়েছে? যে কোনো প্রাচীন শহরেই রাস্তাঘাট অপ্রশস্ত থাকে। ঢাকায় তো রীতিমতো শত শত গলির সংবাদ পাওয়া যায়। এসব গলিতে বড়জোর ঘোড়ার গাড়ি চলত। তার আগে পালকি, ডুলি এসবের চলাচল ছিল। তবে নৌ ব্যবস্থা এই শহরটায় বেশ জোরদার ছিল। অসংখ্য খাল শহরটায় নৌ চলাচলের জন্য একটা সুব্যবস্থা করেছিল। কালক্রমে শহরের রাস্তা প্রশস্ত হয়েছে এবং গত কয়েক দশকে বেশ কিছু নতুন রাস্তাও নির্মিত হয়েছে। একটি আধুনিক ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শহরটাকে মানুষের চলাচলের যোগ্য করতে পারত। কিন্তু অনেক দিন ধরেই এই নগরী আদিম ট্রাফিক ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ছে।
বহু বছর ধরে এও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মহানগরটি 'ভিআইপি শাসিত' হয়ে গেছে। পুলিশ, আমলা, রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য এই ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। যখনই দীর্ঘ যানজট হয়, মানুষ বলাবলি করতে থাকে, রাস্তায় কোনো ভিআইপি চলাচল করছে। অগণিত ভিআইপির শহর এই ঢাকা। পুলিশের ভিআইপি শুরু হয় নিম্নপদস্থ পুলিশ অফিসার থেকে, যাঁরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আমলাদের ক্ষেত্রে শুরু হয় আরেকটু বড় জায়গা থেকে। রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেও তাই। সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য; তাঁদের থেকে। কিন্তু ট্রাফিক কনস্টেবল এবং সার্জেন্ট কোটি লোকের এই মেট্রোপলিটন শহরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অথচ স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেমের ওপর নির্ভর করলে যানজট যে দ্রুতই কমে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ শুধু আইন ভঙ্গকারীদের নিয়ন্ত্রণ করবে। কিছু জায়গায় আবার ট্রাফিক সিগন্যাল জ্বলে আর নেভে। তাতে দেখা যায়, লাল বাতিতে গাড়ি চলছে, সবুজ বাতিতে গাড়ি বন্ধ হচ্ছে।
ওদিকে রিকশা এখন নগরীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান যানবাহন। লাখ লাখ রিকশা যে কোনো রাস্তায় তাদের নিজস্ব নিয়মে চলছে। নগরীর রিকশাচালক অধিকাংশই কৃষি থেকে উঠে আসা। কৃষি আর এখন লাভজনক নয় বলে তারা নগরীতে এসে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে রিকশা চালাতে শুরু করে। ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া তাদের নিত্যদিনের কাজ। কৃষি থেকে উঠে আসা এসব শ্রমিকের কর্মসংস্থানের কথাও সরকার ভাবছে না। বরং ভোটের রাজনীতিতে তাদের প্রয়োজনটার ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যেহেতু শহরে গণপরিবহনের সংকট রয়েছে এবং সেখানেও অকারণে ভাড়া বৃদ্ধি একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জনবহুল এ শহরে কোনো অবস্থাতেই বাস সমাধান হতে পারে না। বাস নামিয়ে সমাধান আনার চেষ্টায় যানজটই বেড়েছে কেবল। এমনকি অতিরিক্ত ব্যয়বহুল মেট্রোরেলও কোনো সমাধান নয়। কিন্তু অতি বুদ্ধিমান প্রযুক্তিবিদরা সরকারকে এসব ব্যবস্থা নিতে নানা অজুহাতে বাধ্য করেছেন। অথচ সব বড় শহরেই মাটির নিচে চলাচল প্রাধান্য পেয়েছে। আমাদের এখানেও এটা হতে পারত একটা বড় সমাধান। মেট্রোরেল কিছু এলাকায় কিছু দিনের মধ্যেই চালু হচ্ছে। তখনই বোঝা যাবে, যাত্রীদের কতটা সুবিধা হলো। ঢাকা শহরে মেট্রোরেলের পরিবর্তে যদি পাতাল রেল করা যেত, তাহলে শহরটা অনেক বেশি যানজট ও দূষণমুক্ত হতে পারত। মেট্রোরেলের নিচে ঘন অন্ধকার বিরাজ করত না।
নগরীতে ফ্লাইওভার কিছু ক্ষেত্রে কাজে দিলেও অনেক ক্ষেত্রে যানজট বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন মৌচাক থেকে বাংলামটরে যে ফ্লাইওভার, তাতে যানজট হলো কয়েক গুণ। ফ্লাইওভারের নিচে দোকানপাট, যানজটে আবাসিকদের কষ্ট বেড়ে গেল। পুরো এলাকাটি সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলল। একমাত্র মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এবং মালিবাগ থেকে সায়েদাবাদ ফ্লাইওভারটি অনেকটা কাজে এসেছে। আবার মহাখালী ফ্লাইওভার যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানেও তীব্র যানজটের সৃষ্টি করছে।
যানজটের কারণে অর্থনীতির যে বিপুল ক্ষতি হয়, তা সবার জানা। এ কথাও সবাই জানেন, যানজটের কারণে অনেক মুমূর্ষু রোগী হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। পথিমধ্যেই অনেক সময় রোগীর মৃত্যু ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের সেবাও অনেক সময় পাওয়া যায় না। এসব নতুন করে বলার কোনো অবকাশ নেই।
আমাদের প্রতিবেশী কলকাতা, যেখানে পুরোনো পথঘাট খুবই অপ্রশস্ত ছিল। ঘরবাড়ি, দালানকোঠাও ছিল প্রাচীন। যানজটের কারণে কলকাতা শহর যে অচল হয়ে পড়েছিল, তা স্বচক্ষে দেখেছি। কিন্তু নতুন লোকালয় গড়ে রাস্তা প্রশস্ত করায় এটি এখন যানজটশূন্য নগরী। একই অবস্থা ছিল নিউইয়র্ক শহরেও। পাতাল রেলকে প্রধান পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলে এবং নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে শহরটাকে তারা বাসযোগ্য করে তুলেছে। লন্ডন অথবা হংকং বলতে গেলে প্রতিনিয়ত তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা আধুনিক করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদ, সিটি করপোরেশন, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, আরও নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবাগুলোর সমন্বয় করে তারা একটি টেকসই যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে। কিন্তু ঢাকা নগরীতে তেমন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ছে না।
ঢাকায় নতুন নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। দিগন্ত সংকুচিত করে শত শত অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে উঠছে। তাতে শুধু রবীন্দ্রনাথের কবিতাই মনে পড়ে- 'ইঁটের 'পরে ইঁট, মাঝে মানুষ-কীট'। আবার ব্যবসায়িক স্থাপনার জন্য এত বেশি অনুমোদন দেওয়া হয় যে, শহরটাই শ্রীহীন হয়ে পড়ে। সেদিকে নীতিনির্ধারকদের কোনো খেয়াল নেই। নগর কর্তারা এই সহজ কথাটি বোঝেন না, যেখানে একটি দোতলা বাড়িতে ১০ জন বসবাস করত, গাড়ি ছিল মাত্র দুটি; সেখানে এখন শতাধিক মানুষ বসবাস করে। গাড়ির সংখ্যা ১৫-২০টি। আর রাস্তা রয়ে গেছে সেই প্রাচীন ধাঁচেই। মানুষ চলাচল করবে কীভাবে?
এখন যানজট জেলা-উপজেলা ছাড়িয়ে ছোট ছোট শহরেও প্রসারিত। গ্রামাঞ্চলে ঘরবাড়ি নির্মাণে কোনো বিধিনিষেধ বা আইনকানুন প্রণীত হয়নি। হঠাৎ ধনীরা গ্রামে গিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করছে। কৃষিজমির বারোটা বাজিয়ে রাজনীতিতে অংশ নিয়ে লুটেরা টাকা ভোগ করে তারা। আজকের দিনে যে কোনো উপজেলা শহর দিয়ে গেলে যানজটের জন্য বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। মহানগর কিংবা মফস্বল- এই অপেক্ষার যেন শেষ নেই।
আমাদের প্রযুক্তিবিদ, আমলা এবং রাজনীতিবিদরা এসব যে বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু অধীত জ্ঞানকে কাজে লাগানোর কোনো চেষ্টা দেখা যায় না। আমাদের দেশেও যে পরিকল্পিত যাতায়াত ব্যবস্থা সম্ভব, তার প্রমাণ হাতিরঝিল। হাতিরঝিল নির্মাণ করে জনগণকে অনেকটাই স্বস্তি দেওয়া হয়েছে। নীতিনির্ধারকরা, কর্তারা আন্তরিক হলে ঢাকার অন্যান্য অংশের মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যেত।
মামুনুর রশীদ :নাট্যব্যক্তিত্ব