আর্মেনিয়া থেকে রুয়ান্ডায় গণহত্যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হয়। হয় বিতর্ক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) ১৯৭১ সালে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার নিন্দা এমনকি বৈশ্বিক পর্যায়ে কোনো আলোচনাই হয় না। গত ১৫ অক্টোবর কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান কংগ্রেসম্যান রোহিত খান্না মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে প্রথমবারের মতো একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, যাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জাতিগত বাঙালি ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে উত্থাপিত এই প্রস্তাবে গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার দাবিও করা হয়েছে।

'অপারেশন সার্চলাইট' নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যার সূচনা করেছিল। প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল এবং চার লাখেরও বেশি বাঙালি নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের বাঙালি দোসররা বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অধ্যাপকদেরও নিশানা করেছিল। পাকিস্তানের সামরিক দপ্তর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিল যে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ওই বর্বর উপায়ে দমন করতে পারবে। কিন্তু তাদের হারিয়ে দিয়ে স্বাধীন ভাষামাতৃক দেশ বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়।

১৯৪৮ সালে গণহত্যার অপরাধের কনভেনশন এবং শাস্তি সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন (সিপিপিসিজি) অনুসারে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যা ঘটেছিল, তাকে গণহত্যা বলা উচিত। কিন্তু তা করা হয়নি। কেননা মার্কিন মুলুক বা পাশ্চাত্যের দেশগুলো এটিকে গণহত্যা বলে না। দেখতে দেখতে ৫০ বছর কেটে গেছে। ওয়াশিংটন বা জাতিসংঘ কেউই পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তানের কাজকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক শাসক দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুস্পষ্ট কারণে মনোযোগ দেয়নি। আর্চার ব্লাড- তৎকালীন ভারতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত- মার্কিন কর্মকর্তাদের ব্রিফ করেছিলেন কিন্তু পাকিস্তান তাদের স্নায়ুযুদ্ধের মিত্র হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করে। রাষ্ট্রপতি নিপন পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ডকে উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপতির আসনে থাকাকালীন ঘটেছিল বিশ্বের একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার এই উন্নয়নকে অনৈতিক আখ্যা দিলেও মার্কিন প্রশাসন এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা থেকে বিরত থাকে।

গত অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রস্তাবটি উপস্থাপনকারী রিপাবলিকান প্রতিনিধি স্টিভ শ্যাবট টুইটারে বলেছেন, 'বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ওহাইওর ফার্স্ট ডিস্ট্রিক্টে আমার হিন্দু ভোটারদের সহায়তায় রোহিত খান্না এবং আমি বাঙালি ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আইন প্রবর্তন করেছি।

হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে রেজুলেশন পেশ করে ক্যালিফোর্নিয়ার ১৭তম কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্টের মার্কিন প্রতিনিধি ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী খান্না টুইট করেছেন- ১৯৭১ সালের বাঙালি গণহত্যার স্মরণে প্রথম রেজুলেশন উপস্থাপন করার জন্য স্টিভ শ্যাবটের সঙ্গে যোগ দিতে পেরে গর্বিত, যেখানে লাখ লাখ বাঙালি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হয়েছিল বা আমাদের সময়ের সবচেয়ে ভুলে যাওয়া গণহত্যার মধ্যে বাস্তুচ্যুত।

এই দু'জনের করা রেজুলেশনে বলা হয়েছে, তিনি মার্কিনভিত্তিক এনজিও লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন এবং জেনোসাইড ওয়াচ পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

বিশ্বের অন্যান্য গণহত্যা আজও বিশ্বব্যাপীই তীব্রভাবে নিন্দা ও সমালোচিত হয়। এর কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃহৎ শক্তিগুলো এগুলোর স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছে। বাংলাদেশের গণহত্যার পাঁচ দশক হয়ে গেছে অথচ বাংলাদেশ এখনও ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে। আমেরিকান কংগ্রেসম্যানরা প্রশংসারযোগ্য একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে এটিকে আরও এগিয়ে নিতে ঢাকার আরও কাজ করা উচিত। গোটা দুনিয়ায় উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ পেয়েছে সুখ্যাতি। শান্তিরক্ষা অভিযানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে এই দেশ। তাই গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেতে বাংলাদেশ তার মার্কিন ও পাশ্চাত্যের কূটনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগাতে পারে।

গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের গণহত্যার স্বীকৃতি অপরিহার্য। একবার তারা স্বীকৃতি দিলেই পাকিস্তানকে ক্ষমাপ্রার্থনা ও ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা যাবে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইসলামাবাদ ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা ক্ষমা চাওয়ার মনোভাব দেখায়নি। উপরন্তু মার্জনা চাওয়ার প্রসঙ্গ এলেই তা এড়িয়ে গিয়েছে। হামুদুর রহমান কমিশনের ব্যাপারেও তারা কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশ বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য লড়াই করেছে এবং ন্যায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে রেজুলেশনের ফলে গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতির পথ প্রশস্ত হলো।