নির্বিচারে বালু উত্তোলনের বিপদ
চারদিক

.
মো. সম্রাট হোসেন
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২৩:১৭
উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পের কাজ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এসব উন্নয়নের ক্ষেত্রে নির্মাণকাজে নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে বালু অন্যতম উপকরণ, যা নির্মাণকাজে সরাসরি সম্পৃক্ত। এটি এমন এক পর্যায়ে এসেছে, যেখানে বালুকে ‘নতুন সোনা’ বলা হয়। ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম দাবি করেছে, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৩২ থেকে ৫০ বিলিয়ন টন বালু ও পাথর আহরণ করা হয়, যা বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দৃশ্যমান। যেহেতু অধিকাংশ শহর নদীর কাছাকাছি, তাই পরিবহন খরচ কমাতে বালু মূলত নদী থেকেই আহরণ করা হয়। এ ছাড়াও বালু অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়া হয়। এর অবশ্য ইতিবাচক দিকও রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, ব্যবসার সুযোগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মূল রাজস্বের উৎস হিসেবে এটি বড় ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে, যা স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গাড়িচালকদের জন্য বড় উপার্জনের ক্ষেত্র এবং পণ্য ও পরিষেবা প্রদান করে। গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তোলন এলাকায় অপরাধের হার কমে যায়। যার মূল কারণ হতে পারে বালু উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট কর্মসংস্থান। অন্যদিকে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর নতুন আবাসস্থল এবং নদীর নাব্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বালু উত্তোলনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন পরিবেশের ওপর খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা বিশ্লেষণ করতে হলে কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। যেমন– উত্তোলনের স্থান, আয়তন, সময়, অন্যান্য খনি, সংশ্লিষ্ট এলাকার জীববৈচিত্র্য ও উত্তোলনের প্রাযুক্তিক ব্যবস্থা। এ কারণে বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের আইন রয়েছে। আমাদের দেশে রয়েছে ‘বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০’। এ আইন অনুসারে (ধারা-৪) বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বনসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। নদীর ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মৎস্য, জলজ ও স্থলজ প্রাণী, ফসলি জমি বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হয় বা হওয়ার আশঙ্কা থাকে এমন পর্যায়ে বালু ও মাটি উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১১ অনুসারে, নদীর তলদেশ থেকে ড্রেজিং পদ্ধতিতে বালু বা মাটি উত্তোলন করলে মাটি কাটার পর পানির নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ গভীরতা ১২ ফুটের বেশি হবে না এবং নদীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে ১:৩ ঢাল সংরক্ষণ করে বালু বা মাটি উত্তোলন করতে হবে।
বালু উত্তোলনের বড় প্রভাব পড়তে পারে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। নদী থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলন নদী ছেদ ত্বরান্বিত করে। সে ক্ষেত্রে নদী-সংলগ্ন এলাকায় খাবার পানির জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। যার ফলে ওই এলাকায় পানিবাহিত রোগের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে নদী ছেদের ফলে নদীনালা-সংলগ্ন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নমুখী হতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাস পেলে এর প্রভাব মানবজীবনে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমাদের অজানা নয়। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
মো. সম্রাট হোসেন: গবেষক, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট
mshossain.bisr23@gmail.com;