মানুষের পরিচয় ‘ট্রান্সজেন্ডার’ এবং সমাজ
মানবাধিকার

.
হাস্নাহেনা
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০২:১২
মানুষের পরিচয় বা আইডেনটিটির নির্দেশক খুঁজতে তিনি কে, কী তার রূপ, কোথায় তার উৎসরণ, তার গতি এবং বহমানতাই বা কোন দিকে? এসব প্রশ্ন নিয়ে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ভিত্তিতে বৈশ্বিক নিরিখে কথা বলার সুযোগ আছে। তবে দেশে সম্প্রতি মানুষের পরিচয় এবং তার অধিকার নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বদৌলতে যে বিভ্রম দেখা যাচ্ছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং শঙ্কার। এটি আশ্চর্যের নয়, কেননা এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে যে কারণ, তার দায় আমাদের সবার।
বিষয়টির সূত্রপাত ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এক খণ্ডকালীন শিক্ষকের বক্তব্য এবং আচরণকে কেন্দ্র করে। তিনি গত ১৯ জানুয়ারি এক সেমিনারে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ‘শরীফার গল্প’-তে উল্লিখিত ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ (থার্ড জেন্ডার) সূত্রে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অগ্রহণযোগ্য কথা বলে সংশ্লিষ্ট পাতা দুটি ছিঁড়ে ফেলেন এবং অন্যদেরও এ কাজ করার আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, ওই সেমিনারের শিরোনাম ছিল– ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’। এটি প্রতীয়মান হয়, আয়োজনটি ছিল সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এরই সংক্রমণ ঘটেছে ছাত্রদের মধ্যে, যা প্রমাণ হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যের পক্ষে তাদের অবস্থান এবং বিভেদাত্মক সহিংস প্রকাশে। এ ক্ষেত্রে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভূমিকার বিষয়ে শুভবুদ্ধির মানুষেরা যৌক্তিক কারণেই তাদের ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন।
এ দেশ যে কোনো ভিন্নতা নির্বিশেষে প্রত্যেকের। নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণিবিশেষের নয়। মানুষের পরিচয় সে মানুষ। নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, ধনী-গরিব, সাদা-কালো ইত্যাদি নয়। তাই যদি হতো, তবে মানুষ স্রষ্টা এবং সৃষ্টির বৈচিত্র্যের সবটুকুই জানে বলে দাবি করতে পারত। তা যখন নয়, তাই আমাদের চারপাশের সব প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি প্রত্যেকের শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। এই বার্তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের শিশু-কিশোরদের কাছে দেওয়া প্রয়োজন। থার্ড জেন্ডার, ট্রান্সজেন্ডার, সমপ্রেমী, বিপরীতপ্রেমী, ট্রান্সসেক্সুয়াল ইত্যাদি নামে বিভেদ-বৈষম্য কোনো সভ্য সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। লিঙ্গ এবং যৌন বৈচিত্র্যের মানুষেরা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। প্রতিটি মানুষই অনন্য। যিনি যেভাবে সৃষ্টি হয়েছেন, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র তাঁকে সেভাবেই গ্রহণ করবে। এটাই প্রাকৃতিক এবং বাঞ্ছিত। শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ কিংবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে এটা হয়েও আসছে। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডারদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা সমাজমানসে, অন্য কথায় সামাজিক। এর মূলে রয়েছে যথাযথ শিক্ষার অভাবপ্রসূত আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আর অযৌক্তিক ও নিপীড়নমূলক মূল্যবোধ বা ভাবধারার চর্চা। একটি শিশুসন্তান জন্মের সময়ে লৈঙ্গিক পরিচয়ে ছেলে কিংবা মেয়ে যাই হোক, কেন সে পরিবারের ভালোবাসা পেয়ে মুক্ত আলো-বাতাসে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের মতো প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না। কেন তাকে অবহেলা, নির্যাতন করা হবে। তার আত্মমর্যাদাকে অস্বীকার, উপেক্ষা করে কেন তাকে হাস্যকর অপাঙ্ক্তেয় করে তুলবে। কেন তার অন্তর্গত অনুভবকে অস্বীকার করা হবে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেন তাকে বাইরে ঠেলে দেওয়া হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব অন্যায়-অনাচারের মোকাবিলা করা প্রয়োজন।
‘হিজড়া’ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা, যাকে দাপ্তরিকভাবে তৃতীয় লিঙ্গ বা থার্ড জেন্ডার বলা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ‘লিঙ্গ’ এবং ‘যৌন’ বৈচিত্র্যের মানুষেরা রয়েছেন। এই জনগোষ্ঠীর জীবনাবস্থার সার্বিক এবং যথার্থ উন্নতি চাইলে ‘লিঙ্গ’ এবং ‘যৌন’ বৈচিত্র্যের বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে বা খণ্ডিত করে বিচ্ছিন্নভাবে এগোলে তাতে সাফল্যের সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। কেননা ‘যৌনাঙ্গ’ এবং ‘যৌনতা’ দুটি ভিন্ন বিষয় হলেও ব্যক্তির পরিচয় বা আইডেনটিটির ক্ষেত্রে দুটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ নেই। এটি নীতি-পরিকল্পনাপ্রণেতাদের বিবেচনায় থাকা প্রয়োজন।
জেন্ডার, যৌনতা বিষয়ে দ্বিধা, জড়তা ও ভয় কাটিয়ে যত বেশি খোলাখুলি কথা বলা এবং লেখালেখি প্রকাশ করা যাবে, এগোনোর পথ ততই প্রশস্ত হবে। পরিবার তথা মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। সচেতন শুভবুদ্ধির মানুষেরা জানেন, এ নিবন্ধে উপস্থাপিত বিষয়টির দুটি বড় অনুষঙ্গ হচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, যা নিষিদ্ধ করার দাবি রয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব রয়েছে জাতিকে অসাম্প্রদায়িকতা, অগ্রসর চিন্তা, সমতা এবং ন্যায়-ন্যায্যতা চর্চায় এগিয়ে নেওয়ার। তারা তা পালন করবে এই আশা আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, জাতিসংঘ সংস্থা