ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত

আন্তর্জাতিক

বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত

.মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ছবি: সংগৃহীত

জেসমিন এল-গামেল

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০২:১৩ | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৬:৫৩

৭ অক্টোবরের পর সম্প্রতি পঞ্চমবার মধ্যপ্রাচ্যে গেলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন, ইতোমধ্যে যা শেষও হয়ে গেছে। তবে এখনও বাইডেন প্রশাসন আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য নিছক ক্ষতস্থান আড়ালের চেষ্টার বাইরে একটি সামগ্রিক মার্কিন কৌশল তৈরি করতে পারল না।

২৯ জানুয়ারি ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীর হামলায় জর্ডানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। গত সপ্তাহে এর জবাব হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র  ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত দলগুলোর ওপর হামলা চালিয়েছে। সেই সঙ্গে ইয়েমেনে হুতিদের ওপরও আক্রমণ চালানো হয়েছে। তবে এতেও ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ হিসেবে পরিচিত গ্রুপে ইরানের প্রক্সি হুতি, হামাস ও হিজবুল্লাহকে দমানো যায়নি। তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশটির সহযোগী ও এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি থমকে আছে। ইসরায়েল ও হামাসের নেতৃত্ব স্থায়ী যুদ্ধবিরতি থেকে তাদের সর্বোচ্চ পাওনা একবিন্দুও ছাড়তে অস্বীকার করেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলাপের গতিও ৭ অক্টোবরের ঘটনার আগের মতো নেই। মধ্যপ্রাচ্য ও এ অঞ্চলের উত্তপ্ত সংঘাতকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের কারণে জো বাইডেন নিজের দেশেও দ্রুত সমর্থন হারাচ্ছেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে তার কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে, যার শিকড় হবে বাস্তবতার মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন স্বার্থরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করার একটি কৌশল বের করা; কিন্তু তা না করে বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা দল বরং মরিয়া হয়ে পূর্বতন মার্কিন প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কৌশল সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে মনোযোগ দেয়।  
৭ অক্টোবর হামাসের ভয়াবহ হামলা এবং তার জবাবে ইসরায়েলের গাজায় ত্বরিত ও ধ্বংসাত্মক আক্রমণ বাইডেনের সেই নেই কাজ তো খই ভাজ মার্কা ‘কৌশল’ একভাবে ভেঙে পড়ে। এতে তাঁর অগভীরতা, আত্মতৃপ্তি ও অদূরদর্শিতা উন্মোচিত হয়, যা এ অঞ্চলকে সংঘাতের তলানিতে ধাবিত করে। বর্তমানে যা দেখা যাচ্ছে।  

আজ গাজা যুদ্ধের প্রায় পাঁচ মাস হলো। যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল, এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতির আকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য তাদের মৌলিক মানবিক আকাঙ্ক্ষাকে ছাড়িয়ে যাবে; তবে তার সে জুয়া খেলা ইতোমধ্যে ঝাঁকুনি খেয়েছে। একদিকে সে হামলার পাল্টা জবাব দেওয়ার পর শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে আরও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ ঠেকাতে মরিয়া চেষ্টা করছে; নির্বাচনী বছরে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান যুদ্ধের বিস্তৃতি বাইডেনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।    

অঞ্চলটিকে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত না করে অ্যান্টনি ব্লিংকেন পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। তিন যেন ডুবন্ত একটি জাহাজের ছিদ্র বন্ধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ছোট তবে শক্তিশালী গোষ্ঠী এ জিকির তুলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও যুদ্ধমুখী হতে হবে।   
কূটনৈতিকভাবে মার্কিনিদের এ ব্যর্থতার কারণ এই নয় যে, স্বভাবগতভাবেই আমেরিকানরা এর জন্য অনুপযুক্ত। এর কারণ বরং এটা যে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন এক প্রশাসন রয়েছে, যারা বিশ্বাস করে না– গাজা যুদ্ধ আঞ্চলিক সংঘাত বাধিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে।  কেবল ইসরায়েলকে থামালেই এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটতে পারে, এটা জেনেও তারা তা করতে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ব্যবহারে অনিচ্ছুক।

এটার মানে এই নয় যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে হামাসের দোষ ও দায় উপেক্ষা করা হচ্ছে। দখলদারিত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও হামলা রুখে দিতে ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতা সত্ত্বেও হামাসই সাম্প্রতিক সহিংসতাগুলো শুরু করেছিল এবং অবশ্যই তাদের পুনরায় হামলা চালাতে দেওয়া যাবে না। কাতার ও মিসর উভয়ে গোষ্ঠীগুলোর ওপর প্রভাব রাখে। দেশ দুটি যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের ব্যাপারে আলাপ করতে হাঁটুগেড়ে বসে আছে এবং তারা হামাস সশস্ত্র নেতৃত্বকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির চরম অবস্থান থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। তবে ইসরায়েলকে নিয়ে আমেরিকা অনুরূপ চেষ্টা করছে তা বলা যাবে না। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেও তাঁর শাসনামলে চরম ডানপন্থি মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির ও বেজালাল স্মোট্রিচের নেতৃত্বে চরমপন্থি ব্লক দ্বারা রাজনৈতিকভাবে জিম্মি হয়েছিলেন। উভয় মন্ত্রী দখলদার এবং ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরে বসবাস করছেন।  উভয়ে যুদ্ধের পর জর্ডান নদীর পশ্চিমে ফিলিস্তিনিদের শাসন কায়েমে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করছে এবং নিজেদের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ে তৎপর রয়েছে।

সবচেয়ে কাছের মিত্রদের এমন একগুঁয়ে অবস্থান সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রে শর্ত দিয়ে কিংবা জাতিসংঘে ইসরায়েলকে দেওয়া রাজনৈতিক আশ্রয় তুলে নিয়ে শান্তিরক্ষার কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতানিয়াহুকে বাধ্য করার কোনো চেষ্টা করছে না।
একইভাবে ইরানের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র অকার্যকর। পারমাণবিক ফাইল ও অঞ্চলটিতে ইরানের ভূমিকার মতো বিষয়ে সে কূটনৈতিক পথের হদিস দিতেও অক্ষম। বরং দেশটি ইরানের প্রক্সিদের বিরুদ্ধে ‘কৌশল’ হিসেবে নিজেদের কৌশলগত হামলার ছদ্মবেশ নেয়। ব্লিংকেন অবশ্যই তাঁর সর্বশেষ সফরে আরব মিত্রদের কাছে থেকে এসব বিষয়ে নানা মত শুনে থাকবেন।

জেসমিন এল-গামেল: পেন্টাগনের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা; দ্য নিউ স্টেটসম্যান থেকে অনুবাদ করেছেন ইফতেখারুল ইসলাম

আরও পড়ুন

×