ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

পাকিস্তান

এই পাকিস্তানি কমিশনারের মাথা খারাপ?

এই পাকিস্তানি কমিশনারের মাথা খারাপ?

রাওয়ালপিন্ডির সাবেক কমিশনার লিয়াকত আলি চাতার- সংগৃহীত ছবি

মাহফুজুর রহমান মানিক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১৯:১১

আমাদের দেশে যা হয় সবই সঠিক হয়। তাই ভুলের দায়ে পদত্যাগ করা তো দূরের কথা ভুল স্বীকারেরও প্রশ্ন আসে না। কিন্তু পাকিস্তান তো স্বপ্নপুরীর মতো দেশ নয়। সেখানে নির্বাচনে কারচুপি হয়। হতেই পারে। বিরোধী দল অভিযোগ করতেই পারে। কিন্তু যখন স্বয়ং রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার স্বীকার করেন যে তাঁর তত্ত্বাবধানেই ভোট কারচুপি হয়েছে, তখন আর কেউ না কেঁপে উঠুক, সেনাপ্রধানের পদ কেঁপে ওঠে। কমিশনার সাহেব আবার পদত্যাগও করেছেন। থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণও করেছেন। তাঁর কি মাথা খারাপ? কেউ কি এভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মারে? কুড়াল মারতে হবে দেশের গায়ে, তাই না?

বস্তুত পাকিস্তানে নির্বাচনের আগ থেকেই কারচুপির গুঞ্জন ওঠে। সেখানে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ইমরান খানকে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি। ছলে-বলে-কৌশলে তাঁকে বাইরে রেখেই নির্বাচনটি সম্পন্ন করা হয়। তিনি কারাগারে থাকলেও, এমনকি তাঁর দল পিটিআইয়ের প্রতীকে নির্বাচন করতে না দেওয়া হলেও নির্বাচন তাঁর সমর্থিত প্রার্থীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এরপরও পিটিআইসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনে। সেখানে নির্বাচনের ফল তদন্তের দাবি ওঠে। রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার লিয়াকত আলি চাতার পদত্যাগের ফলে নির্বাচনে কারচুপির বিষয়টি আরও জোরালো হয়।

শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে লিয়াকত আলি চাতার পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেন একে বোমা ফাটানোই বলা যায়। তাঁর দাবি, রাওয়ালপিন্ডিতে ১৩ জন প্রার্থীকে জোর করে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি এও বলেছেন, ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে– এমন প্রার্থীকেও ভোট বেশি দেখিয়ে জয়ী করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং প্রধান বিচারপতি এই ‘অপকর্মের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

পাকিস্তানের নির্বাচনে দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রভাবের বিষয়টি সবাই জানেন। এবারের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে অনেক আগ থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ইমরান খানও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বলা চলে ইমরান খানকে বাইরে রাখার জন্যই সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদিও এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনে সামরিক বাহিনী ইমরান খানকে সমর্থন দিয়েছিল। নানা কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরে। পরে ইমরান খান অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন ২০২২ সালে। তাঁর বিরুদ্ধে একাট্টা হয় বিরোধী দলগুলো।

যাহোক, এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন (মুসলিম লিগের পিএমএল-এন) নওয়াজ শরিফ। সে জন্য তাঁকে নির্বাসন থেকে দেশে এনে অতি নাটকীয়তায় সব ধরনের দায় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। শত চেষ্টার পরও নির্বাচনে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেননি। অন্যদিকে কোনোভাবেই দমিয়ে রাখা যায়নি ইমরান খানের সমর্থিত প্রার্থীদের। ইমরান খানের দল পিটিআই ৮৫টি আসন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা রউফ হাসান বলেন, ‘আমাদের হিসাব অনুযায়ী জাতীয় পরিষদে পিটিআইয়ের ১৭৭টি আসন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের দেওয়া হয়েছে মাত্র ৯২টি আসন।’

পিটিআইয়ের এ সংবাদ সম্মেলনের পরদিনই রওয়ালপিন্ডির কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করলেন। তিনি সাধারণ কোনো অফিসার নন যে, তাঁর অভিযোগকে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ আছে। প্রশাসনে এসব কর্মকর্তার অনেক ক্ষমতা থাকে। এমনি এক কর্মকর্তার অভিযোগের পর তাই পাকিস্তানে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। লিয়াকত আলি চাতার পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।

লিয়াকত আলি চাতারের পদত্যাগের ঘটনায় সম্পাদকীয় লিখেছে পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডন। তারা লিখেছে, গত কয়েক দশকের মধ্যে এ নির্বাচন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হিসেবে দেখা হবে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের দায় সর্বাগ্রে। সে জন্য নির্বাচনের ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে ডন।

রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার পদত্যাগ করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমাদের জন্য অনুসরণীয়। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের নির্বাচনে কারচুপির বিষয়টি আর অভিযোগের মধ্যে থাকল না। পাকিস্তানের নির্বাচনটি আরও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া মানে দেশটির সংকট আরও তীব্র আকার হওয়া। এর মধ্যেও নতুন সরকার কীভাবে গঠিত হবে, কীভাবেই বা তারা শাসন করবে, সেটাই দেখার বিষয়।

মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com

 

আরও পড়ুন

×