ঢাকা বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কৃষি শুধু বাণিজ্য নয়, জীবন ও সংগ্রাম

খাদ্য

কৃষি শুধু বাণিজ্য নয়, জীবন ও সংগ্রাম

ছবি-সংগৃহীত

মারুফ বরকত

প্রকাশ: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৫:০৯ | আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১৫:১১

১৯৯৭ সালে ঈশ্বরদীতে একটি কৃষক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। দেখা হয়েছিল কুষ্টিয়ার এক বৃদ্ধ কৃষকের সঙ্গে। নাম মনে নেই। শুধু মনে আছে, তাঁর কাছ থেকে একটা গান শিখেছিলাম– ‘আমি যাব আমার দ্যাশে, সুদা (সোজা) রাস্তা নাই।’ আমার জীবনে দেখা সরলতম মানুষ তিনি। ৭৮ বছর বয়সেও উদয়াস্ত কাজ করেন, ফসল ফলান। তিনি বলেছিলেন, কৃষি একটা ইবাদতের মতো। প্রতিটা দিন নিয়ম করে আমি সেই দায়িত্ব পালন করি। নিজের পাশাপাশি আমার পরিবার ও অন্য কিছু মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করি। এটাই আমার কাজ। 

তিনটা দিন তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছি ঈশ্বরদীতে। সারাদিন নানা কাজের ফাঁকে তাঁর কথা শুনতাম। একেবারে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি সব দেখেন। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের খাদ্য নিজে ফলানো। যা ফলাতে পারব না, তা খাব না। ওতে আমার হক নেই। অন্যের ফলানো খাবার খেতে গেলেই লোভ তৈরি হয়। এই লোভই পৃথিবীর সব সমস্যার কারণ। তখন অতটা তলিয়ে দেখিনি– কথাটার মানে কী। প্রায় ২৮ বছর পর হঠাৎ উপলব্ধি করছি, তিনি কী বলেছিলেন। আমি এখন বসে আছি আবুধাবিতে; বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ত্রয়োদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে, বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে। এর আগেও এ ধরনের তিনটি সম্মেলনে গিয়েছি। সীমিত পরিসরেই কথা বলার চেষ্টা করেছি। আমাদের কথা কেউ শোনেনি। জোর না থাকলে কেউ আসলে কারও কথা শোনে না। ১৯৯৬ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কৃষি নিয়ে চুক্তি প্রস্তাব করার শুরু থেকেই সারাবিশ্বের কৃষক চিৎকার করে আসছে। কিন্তু তাদের কথা কেউ শুনছে না।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সোজাসাপ্টা কথা– কৃষি বাণিজ্যের পথে সব বাধা অপসারণ করতে হবে। তারা তাই করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্যগুলোর একটি হচ্ছে কৃষি। কৃষি বাণিজ্যের একটি বাধা হচ্ছে গরিব দেশের কৃষকদের জন্য সরকারি সহায়তা। কারণ বাণিজ্য মানেই মুনাফা। বিশ্বের নানা দেশে কৃষকের পক্ষের মানুষ বলছে– মুনাফা নয়; মানুষের জীবন আগে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বলছে, মুনাফা আগে। মুনাফা হলে গরিব মানুষও তার কিছুটা ভাগ পাবে। মুনাফার চুইয়ে পড়া প্রভাবে গরিব মানুষ ছিটেফোঁটা পাবে ঠিকই; তাতে জীবন চলবে না। বরং তার জীবন থেকে বিশ্বের বড় বড় কৃষি বাণিজ্যওয়ালা সরে গেলে তার ভাগে কিছুটা বেশি পড়বে, যা দিয়ে জীবন বাঁচানোর সুযোগ মিলবে। 

২০০২ সালে মেক্সিকোর কানকুনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনকেন্দ্রের বাইরে আত্মহত্যা করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষক লি কিয়ুং হাই। তাঁর বুকে সাঁটানো প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল– ডব্লিউটিও কিলস ফার্মারস। কৃষক হয়ে এমনিতেও তাঁর মৃত্যু ছিল সামনে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনকেন্দ্রের সামনে গিয়েই জীবন দেবেন। যাতে কৃষক যে মরছেন– তা যেন বিশ্ব দেখতে পায়।

২০০৫ সালে হংকংয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানে লি কিয়ুং হাইয়ের প্রতীকী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হেঁটেছিলাম। অংশগ্রহণকারী কোরিয়ান কৃষকরা কাঁদছিল। আমিও চোখের পানি আটকাতে পারিনি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর কৃষকরা হংকংয়ের রাস্তায় প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। পুলিশ বাধা দেওয়ায় দাঙ্গা বাধিয়ে খবরের কাগজে স্থান পেয়েছিল।

২০১৩ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় দাবি করে আসছে, গরিব কৃষককে ফসলের ন্যায্যমূল্য দিতে উৎপাদিত খাদ্য সরকারকেই কিনতে হবে (পাবলিক স্টকহোল্ডিং) এবং সেই খাদ্য অতি দরিদ্র মানুষকে সংকটের সময় স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে বিতরণ করতে হবে (খাদ্য নিরাপত্তা)। দুটোতেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আপত্তি। এটা করলে বিশ্বের বড় বড় কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী মুনাফা করতে পারবে না। কারণ খাদ্য সংকট যত হবে, তাদের তত মুনাফা হবে। তারা চায়, সরকার যদি কৃষকের কাছ থেকে বাজারমূল্যের বাইরে অতিরিক্ত দাম দিয়ে খাদ্য কেনে, তাহলে তাদের কাছ থেকেও কিনতে হবে। নইলে তাদের লোকসান। 

খবরের কাগজ খুলে দেখলাম, ইউরোপের কৃষকরা বিদ্রোহ করছে। ইউক্রেনে যুদ্ধের দোহাই দিয়ে তাদের খাদ্য রপ্তানির ওপর থেকে রাজস্ব তুলে নেওয়া হয়েছিল, যেটা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভর্তুকিপ্রাপ্ত রপ্তানি ও রাজস্ব মওকুফের সুবিধায় ইউক্রেন থেকে আসা ফসলে বাজার ছেয়ে গিয়ে পোল্যান্ডের কৃষকরা মার খেয়ে গেছে। রেগে গিয়ে তারা আমদানি করা ইউক্রেনের শস্য ট্রেন থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে।

পোল্যান্ডের কৃষকের সেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে ব্রাসেলসের রাজপথেও। কৃষকরা তাদের ট্রাক্টর ফসলের ক্ষেত থেকে নিয়ে এসেছে রাজপথে। সারি সারি ট্রাক্টর বন্ধ করে দিয়েছে রাজধানীর ব্যস্ত চলাচল।

দরিদ্র দেশের দরিদ্রতর কৃষকের প্রতিবাদ হয় ছোটখাটো। খবরের কাগজ তা দেখতে পায় না। রাজদরবারে পৌঁছায় না তাদের কণ্ঠ। লি কিয়ুং হাই অভিমান করে হারাকিরি করে বসেন। ইউরোপের কৃষকের সারি সারি ট্রাক্টর রাজপথ বন্ধ করা দেখে মনে হলো, এত দিনে বুঝি কৃষকের কণ্ঠ জোর পেল।

ব্রাসেলসের রাজপথ আটকে দেওয়া ট্রাক্টরে চড়ে এক কৃষক বললেন, আমি খাদ্য উৎপাদন করব মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। অথচ আমি বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট আয় করতে পারব না; ফসল বিক্রি করে তার উৎপাদন খরচটাও পাব না– তা হতে দেব না।

কানকুনে লিয়ের আত্মাহুতি বা হংকংয়ে কোরিয়ান কৃষকদের সংঘর্ষ বা ভারতে কয়েক হাজার ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী সম্মেলনে তেমন কোনো ঢেউ জাগাতে পারেনি। আবুধাবিতে বসে সেই ঢেউ খানিকটা টের পাওয়া গেল। কৃষকের জয় বুঝি অনতিদূরে। এতদিন কৃষকরা দাবি করছিল, কৃষিকে ডব্লিউটিওর বাইরে রাখো। আজ তারা বলছে– ডব্লিউটিও, কৃষি থেকে দূর হও।

ঈশ্বরদীর বৃদ্ধ কৃষকের গানটা আজ বড় মনে পড়ছে– ‘আমি যাব আমার দ্যাশে, সুদা রাস্তা নাই।’
(আবুধাবি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের ত্রয়োদশ সম্মেলন থেকে)

মারুফ বরকত: পরিচালক, পার্টনারশিপ ও উন্নয়ন যোগাযোগ, কোস্ট ফাউন্ডেশন।

আরও পড়ুন

×