ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

ধর্মের কাহিনি শোনার মানুষ এখনও আছে

বাজার

ধর্মের কাহিনি শোনার মানুষ এখনও আছে

মনোয়ার রুবেল

মনোয়ার রুবেল

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪ | ২১:৩২ | আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৪ | ০৮:৫৪

কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী প্রায় অর্ধসহস্র বছর আগে তৎকালীন মুসলমান সমাজের জাতপাতের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন– মৎস্য বেচিয়া নাম ধরাল্য কাবারি/ নিরন্তর মিথ্যা কহে নাহি রাখে দাড়ি। কাবারি হচ্ছে মুসলমান মাছ বিক্রেতা। তিনি লিখেছেন, তারা নিরন্তর মিথ্যা বলে; দাড়িও রাখে না। 

মুকুন্দরাম বর্ধমানের সন্তান, যা এখন পশ্চিমবঙ্গের অংশ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের কর্মচারী মামুদ শরীফের হাতে নিগৃহীত হয়ে তিনি বর্ধমান ছেড়ে মেদিনীপুরের শাসক বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ে যান। সেখানে তিনি চণ্ডীমঙ্গলকাব্য লেখেন। হাতে-পায়ে কঙ্কণ পরতেন বলে তাঁর উপাধি হয় কবিকঙ্কণ। 

কেউ হয়তো বলতে পারেন, মুসলমানদের প্রতি শ্লেষমিশ্রিত এ মন্তব্য ক্ষোভজনিত। তবে একই কবি গুজরাটে মুসলমান আগমনের দৃশ্যকল্পে মুসলমান দেখতে কেমন হয়, তা নিয়ে লিখেছেন: 

‘বড়ই দানিশমন্দ/ করে নাহি কারো ছন্দ/ প্রাণ গেলে রোজা নাহি ছাড়ি। 
ধরয়ে কাম্বোজ বেশ/ মাথায় না রাখে কেশ/ বুক আচ্ছাদিয়া রাখে দাড়ি।’

(অর্থাৎ মুসলমানরা বড় পুণ্যবান। কারও সঙ্গে প্রতারণা করে না। প্রাণ গেলেও রোজা ছাড়ে না। শরীরে লম্বা কাপড় পরে। মাথায় চুল রাখে না। লম্বা দাড়ি রাখে।)

ভারতে প্রবেশকালে মুসলমান সাধুদের মধ্যে একটি স্নিগ্ধ সহজিয়া ভাব ছিল। কোমলতা ছিল। তাই হয়তো কবি প্রথম দর্শনে লিখেছেন, তারা বড়ই দানিশমন্দ (পুণ্যবান)।

এ দেশে ইসলাম আসার পর এক অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তা ছড়িয়েছে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে সারাবিশ্বের মধ্যে বাংলা অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। সারাবিশ্বে মুসলমান ছিল ২০ কোটি, বাংলায় ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ, অটোমান সাম্রাজ্যে ছিল ১ কোটি ৫৫ লাখ (তথ্যসূত্র: বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: আকবর আলি খান)। তখন আরবে মুসলমান ছিল ৪২ লাখ! ১৮৭০ সালে বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭৬ লাখ। বাংলায় ইসলাম প্রসারের রহস্য এখনও গবেষকদের আগ্রহের বিষয়। কেউ বলছেন, মুসলিম শাসকরা জোর করে ধর্মান্তর করিয়েছেন; কেউ বলছেন, নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলামে বর্ণবাদ নেই জেনে ধর্মান্তরিত হয়েছে। কেউ বলছেন, তারা আফগান, আরব, ইরান থেকে এসেছে। 

কবি মুকুন্দুরাম, জেমস ওয়াইজ, বঙ্কিম বাবু– সবাই বিভিন্ন সময় বলেছেন, ধর্মান্তরিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ। ১৮৭২ সালে বাংলায় আদমশুমারির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন হেনরি বেভারলি। মুসলমানদের আচার-আচরণ, গড়ন ইত্যাদি বিবেচনায় তিনি মনে করতেন, বাংলার মুসলমানরা বিপুলসংখ্যক ধর্মান্তরিত হিন্দু থেকে এসেছে। ১৮৮৩ সালে জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, বাংলায় যে কোনো নোংরা বা অপ্রীতিকর পেশা মুসলমানদের ওপর ন্যস্ত ছিল। হিন্দুর কাছে যা ভুঁইমালী, মুসলমান গ্রামের কাছে বেলদার তাই এবং এটা অসম্ভব নয় যে, তার পূর্বপুরুষও ওই নীচ জাতের অংশ ছিল।

আদি আরবে অনাকাঙ্ক্ষিত কন্যাশিশুকে হত্যা করা হতো। খুনের বদলা খুনের প্রথা ছিল। ইসলাম আসার পর এ দুটি প্রথাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটা আরবের ইতিহাসে একটি বিশাল সামাজিক পরিবর্তন। মুসলিম ইতিহাসবিদরা একইভাবে বাংলায় পুরোনো ধর্মবিশ্বাসে প্রোথিত বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ইসলামকে ত্রাতা হিসেবে দেখিয়েছেন। তাদের লিখিত ইতিহাসে ইসলাম এক নতুন জীবনধারা, যেখানে ন্যায়পরায়ণতাই মূল ভিত্তি।

মুসলমানদের ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা, দানশীলতা ইত্যাদি ভালো দিক সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রোজার মাসে। আরবি বর্ষপঞ্জিতে মাসটির নাম রমজান। এই মাসে মুসলমানরা দিবাভাগে উপোস করে। আল্লাহ দেখে ফেলবেন– এই ভয়ে লুকিয়েও পানি খায় না। এ মাস সংযম ও সংবরণের। যুদ্ধ-বিগ্রহ, এমনকি পাপ হতে পারে, এসব কর্মকাণ্ডও এড়িয়ে চলে তারা। 

কিন্তু পুণ্যের মাসে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ব্যবসায়ীদের কী যেন হয়! তারা ৫ টাকার লেবুর দাম নেয় ২০ টাকা! ৩০০ টাকার খেজুর ১২শ টাকা! ২০০ টাকার তরমুজ ৮০০ টাকা! ৬০০ টাকার গরুর মাংস ৮০০ টাকা! সংযম ও সংবরণ হারিয়ে যায়। 

নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পেশাও বাণিজ্য ছিল। কৈশোরে মেষপালক তিনি যৌবনে হলেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী– সফল, ন্যায়পরায়ণ ও ভালো ব্যবসায়ী। মুসলমানদের কাছে সঠিক ও সৎ পথে ব্যবসা করা নবীর সুন্নাহ (আদর্শ)। কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছেটা কী? 

পবিত্র মাস রমজানে যা হচ্ছে, তাতে মানুষ ক্ষুব্ধ। মানুষের অন্তহীন অভিযোগ। অন্যান্য মুসলিম দেশে যেখানে রমজানে পণ্যমূল্য কমে যায়, এখানে তার উল্টো। মুসলমানদের একাংশ মুসলমানদের পবিত্র মাসে মুসলমানদের পকেট থেকে অবিবেচকের মতো অর্থ আয়ের পথে নেমে পড়ে। এটা নিয়ন্ত্রণে থানা পুলিশ, প্রশাসনের চেয়েও জরুরি হলো নৈতিকতাবোধ। সেটা কি আমরা হারাচ্ছি?

সবাই বিবেকবোধ, নৈতিকতা হারাচ্ছি, তা কিন্তু নয়। শাহজাহানপুরের মাংস ব্যবসায়ী খলিলের কথা না বললেই নয়। অন্য সবাই যেখানে ৭৫০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি করছে, সেখানে তিনি তা বিক্রি করছেন ৬৯৫ টাকায়। শুধু তাই নয়। রোজার আগে থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৬০০ টাকার কমে তিনি মাংস বিক্রি করেছেন। তাঁর দেখাদেখি পুরান ঢাকা, মিরপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে স্বল্পমূল্যে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে। তাঁর প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে ছোট, কিন্তু চারপাশ এত অন্ধকার যে, খলিলের ছোট প্রচেষ্টাটিও জ্বলজ্বল করছে। আলু, পটোল, পেঁয়াজের বাজারেও এমন ‘খলিল’ এগিয়ে আসুক– এটা মানুষ চাচ্ছে। 

সমাজ যখন ঘুণে ধরে যায়; স্বাভাবিক ন্যায়পথে চলা মানুষকে মহৎপ্রাণ ও তাঁর কর্মকে বিস্ময়কর মনে হয়। মাংস বিক্রেতা খলিল তেমনই ব্যতিক্রম। তাঁকে দেখলে কবি মুকুন্দরামেরও মাছ-মাংস বিক্রেতা নিয়ে ধারণা পাল্টে যেত। 

মনোয়ার রুবেল: প্রাবন্ধিক 
 

আরও পড়ুন

×