
আমি যখন এ নিবন্ধটি লিখছি, তখন ২০২২ সালের শেষ সন্ধ্যা। এটি যখন ছাপা হবে, তখন ২০২২ সাল আমাদের জীবন থেকে বিদায় নিয়ে নেবে। বিদায়ী বছরটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুব সুখকর সময় ছিল না। প্রথম দিকে করোনা সংক্রমণ অব্যাহত ছিল। এখনও ছিটেফোঁটাভাবে সংক্রিমত মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। করোনা মহামারির ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে ছিল। এ কথা সত্য, করোনার সংক্রমণ এবং সংক্রমণজনিত মৃতের সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সহনশীল মাত্রায় ছিল। করোনার ফলে গত বছরে এবং তারও আগে আমরা অনেক জ্ঞানী-গুণী, সজ্জন মানুষকে হারিয়েছি। তাঁদের অভাব পূরণ করা সহজ হবে না।
বিগত বছরটি আরও একটি কারণে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কষ্টকর ছিল। বাংলাদেশে মূল্যস্ম্ফীতির হার শতকরা ৯ শতাংশের মতো। এই হিসাব সরকার প্রদত্ত। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ম্ফীতির হার দুই অঙ্কের একটি সংখ্যা। মূল্যস্ম্ফীতি গত বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এর ফলে নির্দিষ্ট আয়ের লোকেরা খুব কষ্টের মধ্যে পড়ে গেছেন। নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দাম দেড় গুণ থেকে দুই গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া দরিদ্র লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা অতিদরিদ্র অবস্থা থেকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে গিয়েছিল, তারা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে গেছে। ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। মূল্যস্ম্ফীতির ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। অনেক মানুষ সঞ্চয় ভেঙে জীবনসামগ্রী ক্রয় করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সম্মানজনকভাবে আয় বৃদ্ধি না পেলে এই লোকগুলো মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবেন। করোনা সংক্রমণের ফলে অনেক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তাদের শ্রমিক ও কর্মচারীরা বাধ্য হয়েছেন নিজ বাড়িয়ে গিয়ে অন্যদের ভোগের ওপর ভাগ বসাতে।
এটা সত্য, বাংলাদেশের মানুষ আগের মতো দরদি নয়। একটা সময় ছিল আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচয় ছিল কৃষি অর্থনীতি। এই কৃষি অর্থনীতিতে কৃষকদের সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। গ্রামীণ সমাজে সুদিন দুর্দিনে ভালো ফলন মন্দ ফলনের সময়ে মানুষ বেকার আপনজনকে নিজে কষ্ট করে হলেও তাদের আহারের ব্যবস্থা করতেন। এমন ধরনের যূথবদ্ধ সমাজের মৃত্যু প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। চরিত্রগতভাবে একটা সময় ছিল যখন গ্রামের মানুষ তার ভাইবেরাদারের জন্য নিজে কষ্ট করে হলেও অসুবিধায় পড়ে যাওয়া আপনজনকে রক্ষা করার চেষ্টা করত। বাজার অর্থনীতির বিকাশের ফলে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সাধারণ গাণিতিক লাভ-ক্ষতি দিয়ে বিচার করা হয়। স্বার্থপরতা বহুবিধভাবে বেড়ে গেছে। এ রকম অবস্থা বাংলাদেশের ট্রানজিশন অর্থনীতির জন্য খুবই সংকটময়। এবার যাঁরা করোনার ফলে চাকরিহারা হয়েছেন, তাঁরা গ্রামে ফিরে গিয়ে আপনজনদের কাছে সব ক্ষেত্রে গ্রহণীয় হয়েছেন বলে ভাবা যায় না। এর জন্য ট্রানজিশন অর্থনীতির চরিত্রটি মূলত দায়ী।
রাজনীতিতে মানুষের ভোটাধিকার সংরক্ষণের দাবি অত্যন্ত প্রবল হয়েছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন খুবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অনেক জায়গায় মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়েও ভোট দিতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় প্রার্থীরা গাল ভরা বুলি আওড়ালেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাঁরা সেসব ভুলে যান। তার পরও ভোটাধিকার এবং ভোটাধিকারের প্রয়োগ বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি আবেগ মিশ্রিত অধিকার। সে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। কিন্তু যখন সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, মানুষ ভোট দিতে পারে না, ভোটকেন্দ্রে নানা ধরনের অপকর্ম হয়- এ রকম অবস্থা লক্ষ্য করে জনগণ খুব অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে। মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ধূমায়িত হয়ে উঠছে।
২০২৩ সালে মানুষের প্রধান আকাঙ্ক্ষা হবে একটি সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন। এর চেয়ে ভিন্ন কোনো ধরনের নির্বাচন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এই মুহূর্তে আমরা দেখছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপিসহ আরও বেশ কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় সংবিধানে সংযোজিত করার দাবি তুলেছে। ২০২৩ সালে এই দাবিতে মানুষ আরও মুখর হয়ে উঠবে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বিরুদ্ধে শাসনক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটেছে এবং এ থেকে পচা-গলা গন্ধ বের হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যথায় বড় দল বিএনপি এবং এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিত্ররা নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে না।
কথাটি প্রধান নির্বাচন কমিশনারও কবুল করেছেন। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে এবং যেসব পদক্ষেপের কথা ভাবছে তাতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থায় প্রচণ্ডভাবে চির ধরেছে। এ রকম অবস্থায় এই নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে নানামুখী কথাবার্তা বলা বন্ধ করতে হবে। তাদের বাক্য সংযম করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছে, নির্বাচন হবে ইভিএম যন্ত্রের মাধ্যমে। এই যন্ত্রটির ওপর দেশের মানুষের আস্থা নেই। এই যন্ত্র ব্যবহার করে যে ভোট অনুষ্ঠিত হবে তার ওপর মানুষের কোনো আস্থা থাকবে না। পৃথিবীর অনেক দেশ ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। ইভিএম যন্ত্রের আরেকটি সমস্যা হলো, এটি থেকে কোনো ব্যালট পেপার বেরিয়ে আসে না। ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্যালট পেপার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন পুনরায় ভোট গণনা করতে হয়। যান্ত্রিক গোলযোগ ও ত্রুটিও ইভিএমকে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, তাদের কাছে ইভিএম যন্ত্রটির যে মজুত আছে তা দিয়ে ১৫০টি আসনে নির্বাচন করা সম্ভব হবে। আরও ১৫০টি আসনে ইভিএম দিয়ে নির্বাচন করার জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ইভিএস মেশিন ক্রয় করতে হবে। দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটে এই ব্যয় অনৈতিক হয়ে উঠবে।
করোনা সংক্রণের ফলে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এতে স্বাভাবিকভাবেই কাম্য শিক্ষার টার্গেটে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এমনিতেই বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে দেশ, রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হবে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করে যথোপযুক্ত সিলেবাস ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা। এই প্রয়াসে দেশের দলমত নির্বিশেষে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাতে হবে। তাদের মধ্যে কে আওয়ামীপন্থি, কে বিএনপিপন্থি তা খোঁজা একেবারেই অনুচিত হবে।
২০২২ সালের শেষের দিকে এসে একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলীকে শাসকদলের অঙ্গসংঠনের নিম্ন পর্যায়ের একজন নেতা চপেটাঘাত করেছে। বাংলাদেশের লোকাচার ও সংস্কৃতি কোথায় নেমে গেছে এটা তারই একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। আমরা কামনা করব, আগামী দিনগুলোতে বিশেষ করে ২০২৩ সালে রাজনৈতিক সহনশীলতাকে উন্নত করতে হবে। রাজনৈতিক সহনশীলতা না থাকলে আমরা জাতি হিসেবে ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। এ অবস্থায় জাতি অন্য দেশের তুলনায় অনেক পেছনে পড়ে যাবে। বাংলাদেশের সামাজিক জীবনেও অনেক ক্লেদ জমে উঠেছে। এ দেশের সমাজ ক্লেদাক্ত, শিক্ষাব্যবস্থা ক্লেদাক্ত, মানুষে মানুষে সম্পর্ক অনেকটাই ক্লেদাক্ত হয়ে পড়েছে। বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে লাখো কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো আগের তুলনায় মজবুত হবে। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বগুণ যদি সঞ্চারিত না থাকে, তাহলে এসব চোখ ধাঁধানো অবকাঠামো দেশের কোনো কাজে আসবে না।
২০২৩ সালে ভারতের সঙ্গে আমাদের দেনা-পাওনার হিসেবগুলোও সঠিকভাবে করতে হবে। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা লাভের জন্য বাংলাদেশকে আরও অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। নদীর পানির স্রোত ভারতে অবকাঠামো নির্মাণ করে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থাকে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে? জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং ভারত কর্তৃক অভিন্ন নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ আমাদের দেশ ও জনগণের জন্য বিশাল এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বরাজনীতিতে এখন দাবা খেলার মতো ঘুঁটি চালাচালি হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এই ঘুঁটি চালাচালিকে প্রবল করে তুলেছে। মনে হচ্ছে, রাশিয়া-চীন মিলে একটি পক্ষ দাঁড়িয়ে যাবে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপ নিয়ে আরও একটি জোট দাঁড়িয়ে যাবে।
বিশ্ব এখন নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধে প্রবেশ করছে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক রাজনীতিতে দাবা খেলার চালগুলো আরও অনেক স্মার্ট হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ এমন জটিল পরিস্থিতিতে কী করবে বা কী করা উচিত তা নিয়ে নতুন বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে একটি চলার পথ বের করে নিতে হবে।
২০২৩ সালে আমরা যেন বুদ্ধিহীন, বিবেকহীন, সুচিন্তাহীন হয়ে না পড়ি। তার জন্যই বছরের শুরুতে আমাদের প্রার্থনা করতে হবে। আমরা চাইব গ্যাস ও বিদ্যুতের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহার না করা হোক। এমনিতেই গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য মানুষকে তার আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এখন ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেশ খানিকটা বেড়ে যাবে। এতে নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন যেমন কষ্টের হবে, পাশাপাশি কলকারখানা, পরিবহন ব্যবস্থা প্রভৃতি খাতে ব্যয় অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। এতে সংকট ঘনীভূত হবে। অথচ মানুষের জীবনে স্বস্তি আসবে না। এ দেশের ১৭ কোটি মানুষ কি একটি স্বস্তিকর জীবনের প্রত্যাশা করতে পারে না?
ড. মাহবুব উল্লাহ: অর্থনীতিবিদ; প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন