২০২৩ সালে অর্থনীতির মূল অগ্রাধিকার কী হবে কিংবা সরকারের করণীয় নিয়ে সুপারিশের জন্য গেল বছরের অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সাল সারা বিশ্বে একটি দুর্যোগপূর্ণ সময় গেছে। বাংলাদেশ যেহেতু পণ্য, সেবা ও শ্রমের ক্ষেত্রে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্পৃক্ত, সেহেতু আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনের বিশৃঙ্খলা আমাদের বেশ প্রভাবিত করেছে। ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কভিডের প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধারের পথে ছিল। কিন্তু গত বছরের শুরুর দিকে ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দিল। পুনরুদ্ধার থমকে গেল। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেল ডলারের দর। ডলারের দর এবং তেল, গ্যাস, কাঁচামালসহ প্রায় সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়াতে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়তে থাকল।

আন্তর্জাতিক মূল্যস্ম্ফীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ দু'ভাবে সংক্রমিত হয়েছে। চিনি, গম, ভোজ্যতেলের মতো যেসব পণ্য আমদানিনির্ভর কিন্তু সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়, সেগুলোর দাম বাজারে বেড়ে গেল। অন্যদিকে জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের মতো সরকার নিয়ন্ত্রিত পণ্যেরও দাম বাড়ল। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যায়। দেশের চলতি হিসাবে গত অর্থবছরে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ঘাটতি তৈরি হয়। সেই সূত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে থাকে। ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের পতন ঘটে। উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতির ফলে করোনার সময়ে সংকটে পড়া দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ নতুন করে সংকটে পড়ে। পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপে দেখা যায়, জানুয়ারি পর্যন্ত এসব মানুষের আয় করোনার আগের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু মে মাসে এসে তা কমে যায়।

প্রশ্ন হলো, সব দেশেই তো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য এবং ডলারের দর প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু সবার সামষ্টিক ব্যবস্থাপনা একই রকম ছিল কিনা।

বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনার কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ডলার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের মনস্তত্ত্ব থেকে বের হতে পারেনি। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে বসে রপ্তানি, আমদানি ও রেমিট্যান্সের বিপরীতে ডলারের একেক রকম দর নির্ধারণ করে দেয়। এতে হিতে বিপরীত হয় এবং ডলার সংকট বেড়ে যায়। আমদানিকারকরা বিপাকে পড়েন এবং একই সঙ্গে রেমিট্যান্সে পতন ঘটে। অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের দিকে প্রবাসীদের ঝুঁকে যাবার প্রবণতা বেড়ে যায়। এ ঘটনা থেকে শিক্ষণীয়, নীতি প্রতিক্রিয়া সঠিক না হলে সংকট সামাল দিতে গিয়ে তা আরও বেড়ে যাবার ঝুঁকি তৈরি হয়।

২০২২ সালের একটি ইতিবাচক দিক হলো বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখের বেশি কর্মী বিদেশ যায়। বছর শেষের পরিসংখ্যানে যা ১১ লাখের কাছাকাছি হবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ গেছেন সৌদি আরবে এবং ওমানে গেছেন ১০ শতাংশ। উল্লেখ করা যেতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদক দেশগুলো বিশ্ব সংকটের সুবিধাভোগী। এসব দেশে মূল্যস্ম্ফীতিও কম। ফলে যদি বিনিময় হারের ওপর নিয়ন্ত্রণ থেকে আমরা বের হতে পারতাম তাহলে গত বছর ৬০০ কোটি বাড়তি রেমিট্যান্স আনা সম্ভব হতো। অথচ তা না করে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের জন্য আমরা কত দৌড়ঝাঁপ করছি।

এখন নতুন বছরের প্রসঙ্গে আসি। ২০২৩ সাল মূলত দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। আমাদের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে এ বছর মন্দার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। তবে ইউরোপের ক্ষেত্রে এ আশঙ্কা ৮০ শতাংশ। যদিও আমাদের রপ্তানির পরিসংখ্যান এখনও পর্যন্ত ঋণাত্মক নয়। মন্দা যদি স্বল্পমেয়াদি হয় এবং গভীর না হয়, তাহলে আমাদের রপ্তানির ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না। তবে মন্দা এবং উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে ঝুঁকি বাড়বে। অবশ্য মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অর্থনীতি দুর্বল হলে মূল্যস্ম্ফীতি এখনকার পর্যায় থেকে কমতে পারে। ইতোমধ্যে ডলারের বাজারে কিছুটা স্বস্তি এসেছে। রেমিট্যান্স গেল ডিসেম্বরে কিছুটা বাড়তে পারে বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য বলছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেবে। এ তো রোগমুক্তি ঘটলে ওষুধ খাবার মতো অবস্থা।

আরেকটি প্রশ্ন হলো, ২০২৩ সালে বাণিজ্য ঘাটতি কেমন হবে। গত অর্থবছরে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন মাসের পরিসংখ্যান বলছে, আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। বৈদেশিক লেনদেন নিয়ে বাড়তি উদ্বেগের জায়গাটি হলো, আগে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থাকত না, এখন থাকছে। যে হিসাব থেকে অর্থায়ন করা হবে, সেখানে ঘাটতি থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। আমার মনে হয়, মূল্যস্ম্ফীতি কমলেও এই অর্থবছরে চলতি হিসাবে ১২ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থাকবে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ১৮ বিলিয়ন ডলারের মতো স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের অপেক্ষায় রয়েছে। আমার ধারণা সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে অর্থায়নের প্রয়োজন হবে অন্তত ২০ বিলিয়ন ডলার। বাজেট সহায়তা হিসেবে নগদে পাওয়া যেতে পারে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। ফলে বৈদেশিক লেনদেনে চাপ অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় সামষ্টিক অর্থনীতি এবং বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিনিময় হার নমনীয় না করলে এবং ব্যাংকের সুদের হারে সীমা তুলে না নিলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

২০২৩ সালে মূল্যস্ম্ফীতি কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, কতটুকু কমবে। যুদ্ধ থেমে গেলে অনেক কমতে পারে। যে অবস্থা চলছে, তা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ম্ফীতি কমবে, তবে খুব স্বাভাবিক হবে না। সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬ মাস ধরে বলা হচ্ছে, দুই মাস পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে দুই মাস পর ঠিক হবে ভেবে নীতি গ্রহণ করলে কাজ হবে না।

তাহলে নতুন বছরে সরকারের করণীয় কী। আমার মতে, প্রধান অগ্রাধিকার হতে হবে খাদ্য এবং জ্বালানি নিরাপত্তা। এর জন্য ডলার সংকট নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। বোরো উৎপাদনে সার, বিদ্যুৎ ও ডিজেল ঠিকমতো দিতে না পারলে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সংকট বাড়বে। এক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভর করে বসে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। বিশ্ব পরিস্থিরি উন্নতি হবে এ আশায় বসে থাকলে হবে না।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট