রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরশীল চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ এই প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসাসেবার ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। কারণ অধিকাংশ মানুষ বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য রাখে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই, অনিয়ম-দুর্নীতি, কাজে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। দিন দিন চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধির পরিবর্তে এর বিপরীতমুখী যাত্রা আমরা দেখছি।
ক্রমেই এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনেক রোগেরই পরীক্ষা করার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। ফলে এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি হলেও প্রায় সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চড়া মূল্যে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করতে হয়। আবার জ্বর, সর্দি, কাশি, বমি, পাতলা পায়খানা- এ রকম রোগের ওষুধের সরবরাহ থাকলেও অধিকাংশ রোগের ওষুধ নেই বললেই চলে। বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয়। এখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক অনেকের মধ্যে সরকারি হাসপাতালের চেয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি মনোযোগী হওয়ার প্রবণতা দৃশ্যমান। এখানে ভর্তি থাকাকালে ওয়ার্ড কিংবা আউটডোরে চিকিৎসকদের রোগী দেখা অনেকটাই দায়সারা গোছের।
ফলে বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষ সামর্থ্য না থাকার পরও জীবন রক্ষার তাগিদে প্রাইভেট চেম্বারে এবং বেসরকারি হাসপাতালে ছুটছে।

চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া- সবারই চিকিৎসা কাজে ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রায়ই তাঁদের কর্তব্যকাজে অবহেলা, উদাসীনতা ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। রোগীদের জন্য যে খাবার সরবরাহ করা হয়, তা নিম্নমানের ও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সেখানে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বাথরুম অপরিচ্ছন্ন ও ব্যবহারের অনুপযোগী। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ দিনেও শয্যাসংখ্যা তেমন বাড়েনি। ফলে হাসপাতালের ওয়ার্ড কিংবা বারান্দার মেঝেতে গাদাগাদি অবস্থান করে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। গুরুতর অসুস্থ রোগী পরিবহনে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া অত্যন্ত দুস্কর। এসবের পাশাপাশি দালাল ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সাধারণ রোগীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে।
জরুরি বিভাগে রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে হাসপাতাল থেকে লাশ বের করা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। এখানে নিয়ম-নীতির লেশমাত্র নেই। প্রতিদিন রোগী ও তাদের স্বজন দালাল, সিন্ডিকেট ও মাস্তানদের দ্বারা হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মাঝেমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এসবের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলেও দৌরাত্ম্য বন্ধ হচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির সুনাম ও ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এখানে চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ; ওষুধ, খাদ্য ও নির্মাণকাজের ঠিকাদারি, সরকারি বরাদ্দসহ নানা বিষয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে এলেও প্রতিকার মিলছে না। সামগ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের অবসান জরুরি।

অসুস্থতার সময় মানুষ বড় অসহায়। এই দুঃসময়ে মানুষের আর্তনাদ ও আহাজারি সত্যিই হৃদয়বিদারক। উন্নত চিকিৎসাসেবাপ্রাপ্তি প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের। রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশ উন্নত এবং এর অনিয়ম দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।

অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ: সাবেক ছাত্রনেতা