প্রায়শ গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে দেখতে হচ্ছে। সব খবর হয়তো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। আমার বাসার পাশেও এমন ঘটনা দেখেছি। এটি সমাজে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা নিজেরা কাজ করি না বলেই গৃহপরিচারিকা নিয়োগ দিই। বিদেশে নিজেদের কাজ নিজেরাই করে। গৃহপরিচারিকা হয়ে যাঁরা কাজে যোগ দেন, তাঁরা নিতান্ত অভাবের তাড়নায় এটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হন। নিয়োগ দেওয়ার পর কোনো কোনো ব্যক্তি এসব কর্মীর সঙ্গে অনেক সময় অমানবিক আচরণ করেন। তাঁদেরকে দাস-দাসী ভাবতে থাকেন। যে কারণে দাস প্রথার সময়ের মতো অমানবিক আচরণের শিকার হতে হয় কাউকে কাউকে। ২০২৩ সালে এসে সেই অন্ধকার যুগের মতো দাসত্ব দেখতে হচ্ছে আমাদের।

১০ বছরের গৃহপরিচারিকা সুমাইয়া আক্তারের পুরো শরীরে খুন্তির ছ্যাঁকা, মারধরের ক্ষতচিহ্ন দেখতে হয়েছে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে। কুমিল্লায় নির্যাতনের শিকার মেয়েটির শরীরের নিচের অংশ গরম পানিতে ঝলসে গেছে। গত ৩ জানুয়ারি রাতে কুমিল্লা শহরতলির ধর্মপুর এলাকায় বাসার দ্বিতীয় তলা থেকে সে লাফিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় গৃহকর্ত্রী তাহমিনা তুহিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একটি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্ত্রীর কাছে আমরা এ ধরনের অমানবিক আচরণ প্রত্যাশা করিনি। যদিও সেই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দাবি করেছেন, ঘটনার সময় তিনি বাইরে ছিলেন এবং তাঁর স্ত্রী এ ধরনের আচরণ করেননি। এটিকে দুর্ঘটনা বলে অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

ওদিকে কুমিল্লায় নির্যাতিত শিশুটির বয়স ১০ বছর। ওই বাসায় কাজ করছে চার বছর ধরে। তার মানে, ৬ বছর বয়স থেকে সে এ কাজে যোগ দিয়েছে। আইএলও কনভেনশন ও শিশু আইন অনুযায়ী এ বয়সীদের কাজে নিয়োগ দেওয়াই অপরাধ। আমরা বুঝি, নিতান্ত অভাবের সংসার না হলে এ বয়সের শিশুদের অন্যের বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে বাবা-মায়ের দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এর আগেও শিশুটির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, তার পরও অভিভাবকরা মেয়েটিকে ওই বাড়িতে রাখতে গেলেন কেন? হয়তো অর্থনৈতিক সংকটের কথা মাথায় রেখেই সব মেনে নিয়েছিলেন। তার মানে, দেশে উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনও অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে। এসব নির্যাতিত পরিবারের খোঁজ নিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে বয়সে একটি শিশুর স্কুলের বারান্দায় সহপাঠীদের সঙ্গে হেসেখেলে সময় কাটানোর কথা, সেই বয়সে অভাবের তাড়নায় অন্যের বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে থাকতে হচ্ছে। কাজ করতে গিয়েও স্বস্তিতে নেই তাদের অনেকে। মাঝেমধ্যে নিয়োগকর্তার নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে।

যাঁরা জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে শিশুটিকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। আমাদের আশপাশে এ ধরনের নির্যাতনের খবর পেলে তাৎক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো উচিত। স্বাধীন দেশে এ ধরনের ফৌজদারি অপরাধ চলতে দেওয়া যায় না। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলার বাদী পাওয়া যায় না। কারণ দুর্বল পরিবারের লোকজন সাহস করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করতে চান না। পুলিশের উচিত বাদী পাওয়া না গেলে নিজেরাই বাদী হয়ে মামলা করা। দুর্বল তদন্তের পাশাপাশি সাক্ষীর অভাবে আসামি যেন ছাড় না পায়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান দেখি। গৃহপরিচারিকা নির্যাতন রোধেও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যেতে পারে। এ জন্য জেলা-উপজেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে।


অতীতে দেখেছি, এসব ঘটনার পর অভিযুক্তরা দায় এড়াতে নানা অজুহাত সামনে নিয়ে আসেন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা অতীতে যেমন হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তাই শুধু আইন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। আদুরিকে নির্যাতনের ঘটনায় এক নারীর সাজা হয়েছে। তাতে কি সুমাইয়ার ওপর নির্যাতন থেমে গেছে? স্ত্রী হত্যার দায়ে কোনো কোনো স্বামীর ফাঁসি হয়েছে। তাতে স্ত্রী হত্যা যেমন থেমে থাকেনি, তেমনি ধর্ষণ মামলায় সাজা হওয়ার পরও সমাজ থেকে ধর্ষণ বিলুপ্ত হয়নি। অর্থাৎ গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের অপরাধে দু-চারজনকে সাজা দিয়ে অন্যদের এ পথ থেকে দমিয়ে রাখা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন যৌথ প্রচারাভিযান।

এটাও মনে রাখতে হবে- গৃহকর্তা বা কর্ত্রীদের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। এই মানসিকতার পরিবর্তনে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা যৌথ উদ্যোগ নিলে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে এই ব্যাধি দূর হওয়া সম্ভব। এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেভাবে কঠোর আইন করা হয়েছিল, সেভাবে গৃহপরিচারিকা নির্যাতনে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কঠোর আইন করা দরকার। শুধু আইন করে এ ব্যাধি দূর করা যাবে না। এর বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। সেই সচেতনতাবোধ সৃষ্টির জন্য প্রচারাভিযান চালাতে হবে। এখানে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাকেও যুক্ত করতে হবে। তবে মূল উদ্যোগটি সরকারিভাবেই নিতে হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হতে পারে পাঠ্যপুস্তকে এসব নির্যাতন বিষয়ে সচেতনতামূলক অধ্যায় সংযোজন করা। তাহলে শিক্ষার্থীরা সচেতন হয়ে তাদের পরিবারে এ ধরনের ঘটনা দেখলে অভিভাবকদের সতর্কবার্তা দিতে পারবে। পাশাপাশি শিশুকালেই নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হলে ভবিষ্যতে তাদের দ্বারা কোনো গৃহপরিচারিকা নির্যাতিত হবে না।

তথ্য মন্ত্রণালয় সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি তথ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান চালাতে পারে। টেলিভিশন চ্যানেলের স্ট্ক্রলে সচেতনমূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। আইন মন্ত্রণালয় আইনে কঠোরতা আনলে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন প্রয়োগে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করলে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে গৃহপরিচারিকার ওপর নির্যাতন ও হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ অনেকটাই নির্মূল হবে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হলে মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে ধর্মগুরুরা মানুষকে সচেতন করতে পারেন। শুক্রবার জুমার নামাজের খুৎবার সময় খতিবরা কথা বললে সেটি মুসল্লিরা মান্য করবেন বলে আশা করি। এসব নির্যাতন শুধু আইনবিরোধী নয়; ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও গর্হিত অপরাধ। ধর্ম প্রচারকরা দাস প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অনেক দাসকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের বেশিরভাগ গৃহকর্মী মধ্যযুগের ক্রীতদাসদের মতোই দিন-রাত খেটেও প্রায়-নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হয়।
এসব নিয়ে এখন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কথাবার্তা হচ্ছে। আগে সেটাও ছিল না। কিন্তু আরও দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সমাজের এ ব্যাধি পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়।

খুশী কবির: সমন্বয়ক, নিজেরা করি