- মতামত
- ঔদাসীন্য
ঔদাসীন্য
করোনা অতিমারিকালে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম হইতে ঝরিয়া পড়া অন্তত সাড়ে ৯ লক্ষ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর গত দুই বৎসর বিদ্যালয়ে ফিরিয়া না আসাটা সত্যিই উদ্বেগজনক। সরকারি তথ্য উদ্ৃব্দত করিয়া সোমবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে- ২০২১ সালে দেশের অর্ধেকের অধিক সংখ্যক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ লক্ষ ৮১ সহস্র শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে নাই এবং ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ৬২ সহস্র। ২০২২ সালে প্রাথমিক স্তরেও এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষাধিক। আরও উদ্বেগজনক হইল, ঝরিয়া পড়া এই শিক্ষার্থী, যাহাদের প্রায় সকলেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান- অর্ধেক সংখ্যকই ছিল কন্যাশিশু এবং তাহাদের মধ্যে ৪৭ সহস্রাধিক ইতোমধ্যে বাল্যবিবাহের শিকার হইয়াছে। আর হতভাগ্য ছেলে শিক্ষার্থীরা নিযুক্ত হইয়াছে বিভিন্ন প্রকার কায়িক এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে। উল্লেখ্য, মারাত্মক প্রাণঘাতী করোনা জীবাণুর বিস্তার প্রতিরোধে ২০২০ সালের মার্চ মাসের মধ্যবর্তী সময়ে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতির কিঞ্চিৎ উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষার সর্বস্তরেই সীমিত পরিসরে শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় আরম্ভ হয়। উপরন্তু ২০২১ সালে প্রাথমিক স্তরে কোনো বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হইলেও মাধ্যমিক স্তরে সীমিত পরিসরে উহা অনুষ্ঠিত হয় এবং গত বৎসর অর্থাৎ ২০২২ সালে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হইয়া আসায় উভয় স্তরে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় পূর্ণাঙ্গরূপে।
বিশেষ করিয়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরিয়া পড়িবার বিষয়টা অতিমারি চলাকালেই এক প্রকার অনুধাবন করা গিয়াছিল। উক্ত সময়ে অসংখ্য বেসরকারি বিদ্যালয় ব্যয় সংকুলানের উপায় না থাকিবার কারণে চিরকালের জন্য বন্ধ হইয়া যায়। শত শত বেসরকারি স্কুল শিক্ষক চাকুরি হারান। অনেকে বেতন-ভাতাদি কর্তনের শিকার হন। এই বিষয়ে অপর গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক- তখন সরকারি উদ্যোগে যে অনলাইন ও দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চলিয়াছিল, উহাতে সরকারি তথ্য অনুসারেই যথাক্রমে ৫৭ ও ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু যহিা হতাশাজনক, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও ঝরিয়া পড়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে বা শিক্ষার ধারায় ফিরাইতে সরকারের পক্ষ হইতে কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় নাই। যদিও সদ্য অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হওয়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট বিভাগের সচিব বলিয়াছেন, উক্ত শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ফিরাইয়া আনিতে প্রয়োজনীয় সকল পন্থাই সরকার গ্রহণ করিবে। বাস্তবতা হইল, অদ্যাবধি ঝরিয়া পড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে কোনোরূপ গ্রহণযোগ্য জরিপ চালানো হয় নাই। এমন আশঙ্কা অমূলক নহে- সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি পূর্বসূরিদের অনুসরণে বর্তমান সরকারও সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন নীতিমালায় যে প্রকার ঔদাস্য প্রদর্শন করিয়া যাইতেছে, বিষয়টা তাহারই অংশ হইতে পারে।
কিন্তু ইহার ফলে শুধু যে উক্ত ঝরিয়া পড়া শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক বিকাশ বন্ধ হইবে তাহাই নহে; সমাজকেও নানা দুর্ভোগ পোহাইতে হইবে। বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু সংস্থা সমীক্ষা করিয়া দেখাইয়াছে, একজন শ্রমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা বৃদ্ধির সহিত মজুরি বৃদ্ধির বিষয় সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। একটা বিকাশমান রাষ্ট্র হিসাবে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা পূরণেও নাগরিকদের অধিক হারে শিক্ষিত করিবার বিকল্প নাই। আর ব্যাপক নারী শিক্ষার ফল পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে কতটা ইতিবাচক, উহাও ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই। সংবিধানের নির্দেশনা- সকল নাগরিকের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব। সেই অনুসারেও এ ক্ষেত্রে সরকার নির্লিপ্ত থাকিতে পারে না। অনস্বীকার্য, সরকার বিনামূল্যে বই প্রদান, উপবৃত্তি, মিড ডে মিলসহ বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু এই সকল পদক্ষেপ যে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ধরিয়া রাখিবার জন্য যথেষ্ট নহে- করোনা অতিমারি তাহা একেবারে চক্ষে অঙ্গুলি চালাইয়া দেখাইয়াছে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার অবিলম্বে ঝরিয়া পড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণপূর্বক বিদ্যমান উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমকে পুনর্বিন্যাস হউক অথবা নূতন কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে উহাদের শিক্ষার মূলধারায় ফিরাইয়া আনিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে।
মন্তব্য করুন