বাংলাদেশের হৃদরোগ চিকিৎসায় স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার জন্য আমার এক আত্মীয়কে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হই। কার্ডের মাধ্যমে ভর্তি করাতে গেলে বিব্রত হই। তখন মনে হচ্ছিল, এই কি আমার ডিজিটাল বাংলাদেশ? ক্যাশ টাকার অভাবে সেদিন আর ভর্তি করাতে পারিনি। এর পরের দিনই একটি কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে গেল। খবরের কাগজের শিরোনাম- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ঘোষণা করেছেন, তাঁর সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে 'স্মার্ট বাংলাদেশে' পরিণত করবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার এমন একটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে যাচ্ছে, যেখানে প্রতিটি জনশক্তিই হবে স্মার্ট, উচ্চগতির ইন্টারনেট প্রবেশ ঘটবে এবং অর্থনীতি হবে ই-অর্থনীতি (ক্যাশলেস অর্থনীতি)। এ ছাড়া আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সবই হবে ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে। সুনিশ্চিতভাবে সবকিছুতে ডিজিটাল ডিভাইস ও এর ব্যবহারের বহুল সন্নিবেশ ঘটবে। এর ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গতিও ত্বরান্বিত হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক 'স্মার্ট বাংলাদেশ' হিসেবে গড়ে তুলতে যে চারটি ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে তা হলো- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সোসাইটি। নিঃসন্দেহে ডিজিটাল বাংলাদেশ দ্বারা নির্মিত লঞ্চ প্যাডের ওপর ভিত্তি করে স্মার্ট বাংলাদেশ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরবর্তী বড় পদক্ষেপ।

আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে- আমরা একটি ট্রানজিশন সময়ের মধ্য দিয়ে যাব। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহের ধারণা নিয়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। কভিড-১৯ মহামারির সময় ২০২১ সালে আয়ারল্যান্ডের হেলথ সার্ভিস এক্সিকিউটিভে ভয়াবহ র‌্যানসমওয়্যার আক্রমণের ফলে দেশব্যাপী আইটি ব্যবস্থাপনায় শাটডাউনের মতো ঘটনা ঘটে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন লক্ষাধিক সাইবার হামলার চেষ্টার ঘটনা ঘটে এবং এর ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ আশঙ্কাজনক। ২০২১ সালে বৈশ্বিক ৬২৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন র‌্যানসমওয়্যার হামলার কথা নথিভুক্ত হয়েছে, যেখানে ২০২০ সালে এই সংখ্যা ৩০৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ছিল।

'স্মার্ট বাংলাদেশ'-এর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নতুন ডাটা সেন্টার খোলার মতো বৃহৎ আকারের প্রযুক্তিভিত্তিক প্রকল্পের প্রয়োজন পড়বে। ডাটা সেন্টার জার্নাল অনুসারে, বাংলাদেশে ১৯টি ডাটা সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে দুটি জাতীয় ডাটা সেন্টার, যার একটি তৃতীয় স্তর এবং অন্যটি চতুর্থ স্তরবিশিষ্ট। যেখানে বাংলাদেশ সরকার দ্বারা উৎপন্ন সব ডাটা সংরক্ষণ করা হয়। এ ছাড়া অনেক ছোট থেকে মাঝারি আকারের বেসরকারি খাতের সংস্থা ডাটা সেন্টার পরিষেবা দেয়, যার বেশিরভাগই তৃতীয় স্তরের মানদণ্ড পূরণ করে না। সে ক্ষেত্রে এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ ডাটা সেন্টারগুলো সাইবার অপরাধী ও রাষ্ট্র সমর্থিত হ্যাকারদের জন্য মূল্যবান লক্ষ্য। তাই আমাদের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার বিষয়টি কোনোভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে বা হবে কিনা ভাবা প্রয়োজন। নতুন নতুন ডাটা সেন্টার স্থাপনের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট হুমকি মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। কেননা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি নতুন কোনো ঘটনা নয়। শুধু ২০১৮ সালেই ৫০ মিলিয়ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছিল। তাই এ ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আইনের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করতে হবে। কেননা একটি দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অপরিহার্য বিষয় এবং এ কারণেই জনগণের আস্থা সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি বহাল থাকে। 

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ডাটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডাটা সেন্টারে সংরক্ষণ করা হয়। একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে দেখলাম নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে বিনিয়োগের ঘাটতি, দক্ষ জনবল এবং ব্যাংকার ও গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতার অভাবে বাংলাদেশের ৩৬ শতাংশের বেশি ব্যাংকে সাইবার আক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ডাটা আসে সিঙ্গাপুর সার্ভারের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে সিস্টেমে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা এবং ডাটা স্থানান্তরের বেশি খরচের চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এ ছাড়া হোস্টিং দেশের ডাটাতে অ্যাকসেস নেওয়ার কথা অগ্রাহ্য করা যায় না। 

আসলে আমরা যত বেশি স্মার্ট হতে থাকব ততই ডাটা সমুদ্রে নিজেদের হারিয়ে ফেলব। ডাটাই হবে আমাদের পরিচয়ের ধারক ও বাহক। তাই একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে চাওয়া- স্মার্ট হওয়ার যাত্রাপথে আমাদের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার বিষয়টি যেন আপসহীন থাকে। নিরাপত্তা ফায়ারওয়াল ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ডাটা দেশের সীমানার মধ্যে রাখতে পারলে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা এবং ডাটা স্থানান্তরের খরচের সমস্যা প্রশমন করা যাবে।