কয়েক দশকে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, সে সঙ্গে বাড়ছে রেমিট্যান্স। ১৯৬৭-৭৭ সালে অভিবাসীদের সংখ্যাটা যেখানে ছিল মাত্র ১৪ হাজার, সেখানে ২০০৭-০৮ সালে তা পৌঁছে রেকর্ড সংখ্যক ৯ লাখ ৮১ হাজারে। তবে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট স্বাভাবিকভাবেই বিদেশের শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করেছিল। যার সাময়িক প্রভাব আমরা দেখতে পাই ২০১১-১২ থেকে শুরু করে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের সংখ্যা হ্রাসের মধ্য দিয়ে। তবে পরবর্তী বছরগুলোয় অর্থাৎ ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের দিকে খানিকটা উন্নতি হতে শুরু করে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৭৬ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ২১ লাখ ৯৯ হাজার ১২৪ জন নারী ও পুরুষ কর্মী বৈদেশিক কর্মসংস্থান লাভ করেছেন। এর মধ্যে ২০০৯-২০১৮ সময়ে ৫৯ লাখ ৩৩ হাজার ৯৫ জন কর্মী বিদেশ গেছেন। তবে রেকর্ড পরিমাণ ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী বিদেশ গেছেন ২০১৭ সালে। সরকারি হিসাবের বাইরেও অনেক বাংলাদেশি আছেন যাঁরা বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে গেছেন এবং বৈধ-অবৈধভাবে সেখানে অবস্থান করছেন। তাই প্রবাসী কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হবে বলা যায়। আবার অনেকে প্রবাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন পরিবার নিয়ে, যাঁরা নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। 

দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যে কয়টি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- এর মধ্যে বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ থেকে। প্রবাসীরা যে কেবল দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সাহায্য করছেন তা নয়, একই সঙ্গে দেশে থাকা তাদের পরিবার-পরিজনদের অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, যা দেশের মূল অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। করোনা মহামারির কারণে রেমিট্যান্স কমে যাবে বলে ধারণা করা হলেও তা হয়নি। কারণ হলো, অতিমারির ফলে অবৈধ পথে অর্থ পাঠানো বাধাগ্রস্ত হয় আর প্রবাসীদের ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। কাজেই দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের অবদান স্বাধীনতার পর থেকেই ছিল এবং এখনও আছে। এখানে বলা দরকার, কেবল বৈধভাবে পাঠানো টাকাই হিসাবে থাকে, কিন্তু এর বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে আসে বিভিন্ন উপায়ে এর অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। গত সাড়ে চার দশকে ২ লাখ ১৭ হাজার মিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে, বছরে এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। প্রবাসীদের পাঠানো এ আয়ের কারণে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই বেশ কয়েকটি নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। কথা হচ্ছে যাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি ও অসংখ্য পরিবার সজীব থাকে, তাঁরা প্রবাসে ও দেশে কী পান?

প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব শ্রম কল্যাণ উইংয়ের। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা গেলেও তাঁদের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষায় ২৬টি দেশের বাংলাদেশ মিশনে শ্রম কল্যাণ উইং আছে মাত্র ২৯টি। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং ইতালিতে দুটি করে শ্রম কল্যাণ উইং আছে। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহারের জন্য সরকার এখন ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে এবং অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়া আগের চেয়ে সহজ করা হয়েছে। কিন্তু এর পরও প্রবাসীরা বাংলাদেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হুন্ডিকে প্রাধান্য দেন। ২০০৬ সালে গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টের (জিইপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পাঠানো প্রবাসী অর্থের ৫৬ শতাংশই আসে হুন্ডির মাধ্যমে। 

প্রবাসীদের হুন্ডি ব্যবহারের প্রবণতার অনেক কারণ আছে। ব্যাংকের চেয়ে বেশি অর্থ পাওয়া ও কোনো জটিলতা না থাকা প্রধানতম। তবে অনেক অবৈধ প্রবাসী আছেন যাঁরা প্রয়োজনীয় কাগজের অভাবে বাধ্য হয়েই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। কিন্তু এর বাইরেও কিছু বিষয় আছে, যা প্রবাসীরা বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। বিদেশে থাকাকালে সংশ্নিষ্ট বাংলাদেশি দূতাবাসের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়া, দেশের বিমানবন্দরে নাজেহাল হওয়া, লাগেজ চুরি বা হয়রানি ইত্যাদি বিষয় তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে; যা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাসপোর্ট নবায়নে মাসের পর মাস লাগে; ফলে অনেকের কর্মক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবার বিদেশে থাকাকালে কোনো ধরনের সমস্যা হলে ওই দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের অবহেলা করার অভিযোগও রয়েছে। এমনকি প্রবাসে দেশের দূতাবাসের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতেও বিড়ম্বনা পোহাতে হয় বলেই অনেকে বলেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে থাকা অদক্ষ বা স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকদের এমন অভিজ্ঞতা অনেক। এমনকি বিভিন্ন সেবার ফি নিয়েও আছে তাদের অভিযোগ।

সরকারের উচিত হবে, এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলো নিয়মিত সেখানে থাকা বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিমিয় করা, তাঁদের সমস্যা জেনে সমাধানে কাজ করা। আবার যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই, সেখানে থাকা কর্মীদের জন্য বিকল্প সেবা ও টাকা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। দেশে ফেরা প্রবাসী কর্মীরা যাতে বিমানবন্দরে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন, সেদিকটি নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের লাগেজ চুরি বা প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সব হারানোর ঘটনা কম নয়। তাই তাঁদের জন্য সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিতেই হবে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স পাঠানোর ভিত্তিতে তাঁদের বিশেষ সুযোগ বা সম্মান দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। দেশে এলে তাঁদের জন্য বিমানবন্দরে বিশেষ ছাড় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা দিলে তাঁদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে বলে আশা করা যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, রেমিট্যান্স দিয়েই দেশের অর্থনীতি ও অসংখ্য পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থা হয় যাঁদের হাত ধরে, তাঁদের অবহেলা করে রেমিট্যান্স প্রত্যাশা আমরা কীভাবে করব?