বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের জনপ্রিয়তার কারণ কী- সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় থেকেই এ নিয়ে দেশ-বিদেশে বেশ কৌতূহল জাগ্রত হয়েছে। এমনকি আর্জেন্টিনায় যেসব বাঙালি বসবাস করেন, তাঁরাও সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে বিশেষ সমাদর পাচ্ছেন। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের জনপ্রিয়তা সিয়েরা লিয়নের পর আর্জেন্টিনায় বেশি দেখা গেছে। সিয়েরা লিয়নে জনপ্রিয়তার কারণ, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর চমৎকার সেবা, যা তারা আগে কখনও পায়নি।

যাই হোক, আর্জেন্টিনা ফুটবল দল এবং সেই সূত্রে দেশটির জনপ্রিয়তা আমাদের দেশে বৃদ্ধির প্রধান সমাজতাত্ত্বিক কারণ সম্ভবত জনসাধারণের মধ্যে 'হিরো ওরশিপ' বা নায়কদের পূজনীয় করে রাখার প্রবণতা। যে কোনো ঐতিহ্যবাহী সমাজে মানুষের সামাজিক সাফল্যকে অনেক বড় করে দেখা হয়। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বক্সার মোহাম্মদ আলী যখন ঢাকায় আসেন তখন বলেছিলেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তিনি এতটা সমাদৃত হননি যতটা বাংলাদেশে হয়েছেন। এটিও ছিল এক ধরনের হিরো ওরশিপ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল প্রাইজ পান, তখন তিনি আকাশের দিকে দু'হাত তুলে যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন এবং অন্যরা যেভাবে সেদিন তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে শুভেচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তাও বিরল ঘটনা। এর প্রধান কারণ, এখানে এখনও হিরো ওরশিপ বিদ্যমান। এখনও এখানে সরকারপ্রধানকে অনেক সাধারণ মানুষ 'রাজা' সম্বোধন করে থাকেন।
স্বীকার করতেই হবে, আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে এখনও পরার্থপরতার বিষয়টি অন্য যে কোনো সমাজের চেয়ে বেশি। পরের হাসিতে হাসি, পরের কান্নায় কান্না এ সমাজে বিদ্যমান। অল্পতে একজনের কষ্টের অংশীদার বা আনন্দে আপ্লুত হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। যূথবদ্ধতার নিয়মটি এখানে প্রকট। একজন বিয়ের আয়োজন করলে অন্যজনকে দাওয়াত না দিলে সম্পর্কে একটি টানাপোড়েন শুরু হয়। এটি দেশে বিদ্যমান একটি সামাজিক মূল্যবোধ; যদিও এখন তা নিম্নগামী, তবে নিঃশেষিত নয়।

যৌথ প্রতিরূপের আরেকটি নজির হলো, এখানে একসঙ্গে খাওয়া বা বসা। বাঙালির আড্ডার মধ্যে একটি সামাজিক প্রতিরূপ রয়েছে, যেখানে তারা মনে করে, তাদের শেয়ার করার অনেক কিছু আছে। কোনো কিছু উদযাপন করতে গেলে একসঙ্গে করতে হয়, এমনকি সীমিত সম্পদ থাকলেও।
সমাজে বিনোদনের অন্যতম উপকরণ হলো আড্ডা। এই আড্ডার প্রধান উপজীব্য পরের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা। আড্ডায় কোনো বিশেষ আলোচ্যসূচি থাকে না। সমাজে যখন যে ঘটনা আলোচিত থাকে, আড্ডাতেও তখন সে বিষয় প্রাধান্য পায়। এ আলোচনায় সাধারণত যার কাছে যে তথ্য থাকে, সে তা পরিবেশন করে। এসব তথ্যের অনেক কিছু থাকে শোনা, জানা বা কাল্পনিক। সেসব তথ্য নিয়ে তখন একে অপরের সঙ্গে আলোচনা, বিতণ্ডা করে। এমনকি কখনও কখনও তা নিয়ে বিবাদও হয়।

এবার ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে দেশে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এটি মূলত তর্ক-বিতর্ক করতে করতে এক পর্যায়ে তারা একে অন্যকে আঘাত করে। এগুলোকে পরিকল্পিত কোনো ঘটনা বলা যাবে না, বরং বলা যায় তাৎক্ষণিক ঘটে যাওয়া। এ ধরনের ঘটনা রাজনৈতিক, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে। তবে এটি ব্যতিক্রম হিসেবে কেউ কেউ ভাবতে পারেন। কারণ বিষয়টি দেশের কোনো অনুষ্ঠান নিয়ে ঘটেনি; ফুটবল বিশ্বকাপকে নিয়ে ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ না খেললেও খেলাটি এ দেশের মানুষ নিজের করে নিয়েছে। খেলাটি নিয়ে বিশ্বকাপ খেলুড়ে অনেক দেশের চেয়েও এ দেশের মানুষ বেশি আলোচিত ও আলোড়িত।
ফুটবল বিশ্বকাপ এখনও জনপ্রিয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের প্রধান খেলা; আমাদের ফুটবল দল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে পারুক বা না পারুক। যদিও ক্রিকেট খেলায় আমাদের দল বৈশ্বিকভাবে প্রথম সারিতে রয়েছে। বিশেষত ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হলে ক্রিকেটসহ বাকি সব খেলার জনপ্রিয়তা ম্লান হয়ে যায়। এবার ক্রিকেটের তারকা খেলোয়াড়দেরও দেখা গেছে পছন্দের ফুটবল দলের জার্সি গায়ে তুলেছেন।
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা নির্ধারণে ফুটবল খেলা বা দলের চেয়ে কিংবদন্তি খেলোয়াড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন বেশিরভাগ মানুষের আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলকে সমর্থনের পেছনে রয়েছে ম্যারাডোনা বা পেলের মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। পছন্দের খেলোয়াড়ের প্রশংসার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের নিন্দা করতেও ছাড়েন না তাঁরা।
এ দেশে আর্জেন্টিনার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি থাকার কারণ বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপজয়ী ম্যারাডোনার খেলা প্রথম টেলিভিশনে দেখার সুযোগ পেয়েছিল। তখন থেকেই বিপুলসংখ্যক মানুষ আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়ে যায়। এবার যেহেতু মেসির শেষ বিশ্বকাপ খেলা ছিল, তাই মেসিভক্তরাও আর্জেন্টিনার ভক্ত হয়ে যায়। মেসির এত ভক্ত হওয়ার প্রধান কারণ, তাঁকে সর্বকালের একজন সেরা ফুটবল খেলোয়াড় মনে করা হয়। সাতবার ব্যালন ডি'অর, ছয়বার ইউরোপের গোল্ডেন শু, চারবার ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন লিগ, ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে বিশ্বকাপ জয় তাঁর অর্জনের ঝুলিকে পূর্ণ করে।

বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থক বেশি হওয়ার আরেকটি বড় কারণ সম্ভবত ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশটির বৈশিষ্ট্য। আর্জেন্টিনা বিশ্ব মোড়লিপনার সঙ্গে যুক্ত নয়; বরং শান্তিপ্রিয়। ফলে এটিকে তারা তাদের নিজেদের একটি পছন্দের দেশও মনে করে। যদিও বাংলাদেশে ব্রাজিলের অনেক সমর্থক রয়েছে, দেশটি বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ায় তাদের একাংশেরও সমর্থন আর্জেন্টিনার প্রতি চলে যায়। তাই এবার বহু মানুষ আর্জেন্টিনার বিশাল পতাকা তৈরি করেছে। আর কত জার্সি বিক্রি হয়েছে, হিসাব পাওয়া কঠিন। এ ছাড়া হাজার হাজার তরুণ-তরুণী একসঙ্গে মাঠে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বড় পর্দায় আর্জেন্টিনার খেলা দেখেছে।
ফুটবল এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমল থেকে জনপ্রিয় খেলা। দেশে আশির দশকে টিভিতে বিশ্বকাপ দেখার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ম্যারাডোনার খেলা দেখে। সে ধারা ধরে আজও আর্জেন্টিনার প্রতি দেশের মানুষের রয়েছে এক গভীর ভালোবাসা, যা এবার বিশ্বকাপ জয়ের কারণে আরও এক ধাপ বেড়েছে।
খেলার প্রতি দেশের মানুষের এ ধরনের উচ্ছ্বাসের গভীর সমাজতাত্ত্বিক কারণ ও প্রভাব রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি সাধারণত উপেক্ষিতই থাকে। যদিও বিআইএসআর নারীদের খেলাসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন খেলার জনপ্রিয়তা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে যাচ্ছে।

ড. খুরশিদ আলম: সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট
khurshedbisr@gmail.com