
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। চূড়ান্ত খসড়াটি গত জুন থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত জনমত জরিপের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রচার করে। যেখানে ১৬৯ জন সংসদ সদস্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ প্রায় ১৬ হাজার বিশিষ্টজন আইনটি সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছেন। অন্যদিকে তামাক কোম্পানিগুলোর পক্ষে ভুয়া ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে খসড়া আইনটি সংশোধনের বিপক্ষে মত দেয় মাত্র ১ হাজার ১০০ জন।
বস্তুত তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য যখনই সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়, ঠিক তখনই শুরু হয় তামাক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন রকম অপতৎপরতা। বিভিন্ন কৌশলে খসড়া আইনের বিপক্ষে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের ভুল তথ্য দিয়ে প্রভাবিত করার জন্য চলে নানা অপচেষ্টা। এমনকি সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ ও পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নেতিবাচক জনমত গঠনেও পিছপা হয় না স্বার্থান্বেষী মহলটি।
ইতোমধ্যে তামাক কোম্পানিগুলো আইনটি সংশোধনের বিষয়ে কিছু পয়েন্টে প্রতিবাদ করছে, যার মূলত কোনো ভিত্তি নেই। এর মধ্যে অন্যতম হলো, স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ না করে মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনের খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাদ পড়া এই স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছে তামাক কোম্পানি ও তাদেরই অনুগত তথাকথিত কিছু সংগঠন।
যদিও তামাক কোম্পানিগুলোর তামাক আইন সংশোধনে স্টেকহোল্ডার হিসেবে বিবেচিত হওয়ার নূ্যনতম সুযোগ নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) আর্টিকেল ৫.৩-এ বলা আছে, 'রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় আইনে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রণীত নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তামাক কোম্পানি ও তাদের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের প্রভাবমুক্ত রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।'
যেহেতু বাংলাদেশ এফসিটিসিতে অনুস্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ, সেহেতু বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ নেই কোম্পানিগুলোর। মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ দেওয়া হলে তা হবে এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ চরম লঙ্ঘন। আর্টিকেলে (৫.৩) তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত রাখার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তামাক কোম্পানির প্রতারণামূলক সব কার্যক্রম বন্ধ করতেও কঠোর মনিটরিং আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ অধিকতর সংশোধনের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত খসড়া আইনটি বাস্তবায়ন হলে দেশের ১৫ লাখ খুচরা ব্যবসায়ী বেকার হয়ে যাবেন- এমন দাবি করছে তামাক কোম্পানিগুলো, যা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। বলে রাখা ভালো, কোনো দোকানিই নির্দিষ্ট করে শুধু তামাকজাত পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন না। শুধু একটি পণ্যের বিক্রি বন্ধ হলে কোনো দোকানি বা ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে না বা তাঁরা বেকার হয়ে যাবেন না- এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
তারা প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনীর বিভিন্ন ধারার বিরোধিতা করে প্রস্তাবনা দেওয়ার সুযোগ চায়। যাতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করার জন্য তাদের সুযোগ নিশ্চিত করা যায় এবং প্রস্তাবিত আইন সংশোধনের মাধ্যমে সেটি যেন বাধাগ্রস্ত না হয়!
অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও সংশ্নিষ্ট সংগঠনগুলো, যেমন- ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইক্যাব, সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা, বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও পেশাজীবীদের সংগঠন, যেমন- বাংলাদেশ সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন-বিএসএসএফের মতো শীর্ষ সংগঠন তামাক আইন সংশোধনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের লক্ষ্য তামাক কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা নয়, বরং জনস্বাস্থ্যকে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা। তামাক কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার দিন দিন বাড়ানো ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা। চূড়ান্তভাবে যা জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে এবং ভবিষ্যতেও ফেলবে।
সরকার আইন করে তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে, যাতে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত হয়। শুধু তামাকজাত পণ্যই নয়, ই-সিগারেট বিক্রি, বিপণন, আমদানি বন্ধে বেশ সোচ্চার সরকার। এ বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গৃহীত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী খসড়া দ্রুত পাস হওয়া দরকার বলে মনে করছি।
বীরেন শিকদার: সংসদ সদস্য, মাগুরা-২; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য
মন্তব্য করুন