- মতামত
- 'ডিসেম্বর উত্তাপে' অভিযানে ভাটা
'ডিসেম্বর উত্তাপে' অভিযানে ভাটা

প্রতীকী ছবি
সব ধরনের অপরাধ মিলিয়ে গত নভেম্বরে রাজধানীর ৫০ থানায় মামলা হয়েছে ২ হাজার ৩৬৯টি। ডিসেম্বরে হয়েছে ১ হাজার ৭৫৩টি মামলা। আগের মাসের তুলনায় ডিসেম্বরে মামলা কম হওয়ায় কেউ হয়তো ধারণা করতে পারেন, সমাজে অপরাধ কমেছে। তবে বিষয়টি এমন নয়। রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে ডিসেম্বরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যস্ত ছিল রাজপথের পরিস্থিতি সামাল দিতে। এতেই ভাটা পড়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি রোধে পুলিশের তৎপরতা এবং অস্ত্র, মাদকদ্রব্য উদ্ধার অভিযানে।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ ছাড়াও ওই মাসে রাজপথে নানা কর্মসূচি ছিল দলটির। আওয়ামী লীগও নিয়েছিল পাল্টা কর্মসূচি। গোটা মাসেই ছিল রাজনৈতিক উত্তাপ। এসব কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান তৎপরতা দেখা যায়। টহল, চেকপোস্ট ও নজরদারি বাড়ানো হয়। এতে মাদকসহ অবৈধ সামগ্রী জব্দ ও অপরাধীদের ধরতে পুলিশের অভিযানিক কার্যক্রম শ্নথ হয়। মাদক মামলায় আসামি গ্রেপ্তারেও ভাটা পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি পুলিশের একটি অংশকে অভিযান এবং তদন্ত কার্যক্রমে নিয়োজিত রাখতে হবে। তা না হলে সমাজে শান্তি বিঘ্নিত হবে।
সাধারণত যে কোনো শহরের অপরাধ চিত্র বুঝতে মামলাকে দু'ভাবে বিশ্নেষণ করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এর একটি হলো- চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতি, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ও চাঁদাবাজির ঘটনায় কম মামলা হলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে উদ্ধারজনিত মামলা কম হলে পুলিশি অভিযানের ঢিলেঢালা ভাবের বিষয়টি সামনে আসে। রাজধানীতে ডিসেম্বর মাসে অস্ত্র, বিস্ম্ফোরক ও মাদকদ্রব্য জব্দ অনেক কমে গেছে। তাই উদ্ধারজনিত মামলাও হয়েছে কম। গত নভেম্বর মাসে মাদক, চোরাচালানের পণ্য জব্দসহ উদ্ধারজনিত মামলা হয়েছিল ১ হাজার ৩৬২টি। ডিসেম্বরে এ ধরনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫টি। অর্থাৎ এক মাসে মামলা কমেছে ৩৫৭টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের সঙ্গে তুলনা করলে এ ধরণের মামলা কমেছে ৫৭৭টি। ওই বছরের ডিসেম্বরে মোট মামলা হয়েছিল ২ হাজার ৪৭৬টি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মামলা ও অভিযানিক তথ্য বিশ্নেষণে এই চিত্র উঠে আসে।
গত বুধবার ডিএমপির সর্বশেষ মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় উদ্ধারজনিত মামলা কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। বৈঠকে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খন্দকার গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে। তাই উদ্ধারজনিত মামলার সংখ্যা কমেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করি। পুলিশি কার্যক্রমে সবদিকে সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে বলা হয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, আন্দোলন কর্মসূচিতে পুলিশের ব্যস্ততা বাড়লে অভিযান ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। তবে এখন সব থানায় পরিদর্শক (তদন্ত) নামে একটি পদ রয়েছে। রাজনৈতিক উত্তেজনার সময়ও পুলিশের একটি অংশকে অভিযান এবং তদন্ত কার্যক্রমে নিয়োজিত রাখতে হবে। এ ছাড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), নৌ, শিল্প পুলিশ ও সিআইডি মামলার তদন্ত করতে পারে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) বিপ্লব বিজয় তালুকদার সমকালকে বলেন, মামলার সংখ্যার পাশাপাশি আমরা গুণগত তদন্তের বিষয়ে জোর দিয়ে থাকি। উদ্ধার অভিযান জোরদারের জন্য পুলিশের তৃণমূল পর্যন্ত নির্দেশনা দেওয়া আছে।
অনেকে বলছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠলে তার প্রভাব জীবনযাত্রার ওপর পড়ে। ডিএমপির ডিসেম্বর মাসে অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন মামলা হয়েছে ৫৮.৪৩টি। এর মধ্যে বাসায় চুরির মামলা হয়েছে ৫০, গাড়ি চুরি ২৪, গবাদি পশু চুরির একটি। সব মিলিয়ে চুরির মামলা হয় ১৪৫টি। উদ্ধারজনিত ১ হাজার ৫টি মামলার মধ্যে মাদক উদ্ধারের মামলা ৯৬১টি, বিস্ম্ফোরক দ্রব্য উদ্ধারের ৩৪, অস্ত্র উদ্ধারের ৩ ও চোরাচালানের দ্রব্য উদ্ধারে ৭টি। নভেম্বর মাসে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে মামলা হয়েছে ৭৮.৯৬টি। নভেম্বরে মোট চুরির মামলা ১৮৫টি। ওই মাসে উদ্ধারজনিত ১ হাজার ৩৬২টি মামলার মধ্যে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মামলা ১ হাজার ৩৩১টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় গত ডিসেম্বরে সব ধরনের মামলার পরিসংখ্যান নিম্নমুখী। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীতে গড়ে মামলা হয়েছে ৮২.৫৩টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে উদ্ধারজনিত মোট মামলা ১ হাজার ৫৮২টি। এর মধ্যে মাদক উদ্ধারের মামলাই ১ হাজার ৫২৫টি।
পুলিশের একাধিক উচ্চপদের কর্মকর্তা জানান, গত ডিসেম্বরে বিএনপির অন্তত পাঁচটি কর্মসূচি ছিল ঢাকায়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগও একাধিক কর্মসূচি পালন করে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছিল। বিশেষ করে ১০ ডিসেম্বর ঘিরে নানামুখী বক্তব্যের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে পুলিশ ও বিএনপির নেতাকর্মীর সংঘর্ষের সময় একজন নিহতও হন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশি মনোযোগ দিতে হয়। এ ছাড়া ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মতো জাতীয় অনুষ্ঠান নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বড় ভূমিকা থাকে।
ডিএমপির ডিসেম্বর মাসের অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ফেনসিডিল উদ্ধারের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ঢাকায় পুলিশের সব ইউনিট মিলিয়ে ডিসেম্বরে ফেনসিডিল জব্দ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৮২ বোতল। গত নভেম্বর মাসে ফেনসিডিল জব্দ করা হয় ১১ হাজার ৮১০ বোতল। ডিসেম্বরে হেরোইন জব্দ করা হয় ১ কেজি ৩৭০ গ্রাম, নভেম্বরে ছিল ৩ কেজি ৮৭ গ্রাম। গাঁজা উদ্ধার করা হয় ৭৮৫ কেজি ৬০০ গ্রাম, নভেম্বরে ছিল ৯০৪ কেজি ৮৩২ গ্রাম। ডিসেম্বর মাসে ইয়াবা জব্দ করা হয় ১ লাখ ২৩ হাজার ৫১ পিস। নভেম্বরে জব্দ হয়েছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬১ পিস। আইস উদ্ধার করা হয় ১১ গ্রাম। আগের মাসে জব্দ করা হয় ১৮ গ্রাম। ডিসেম্বরে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হন ১ হাজার ৫৮ জন। নভেম্বরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১ হাজার ৫২১ জন।
পুলিশের একজন উচ্চপদের কর্মকর্তার ভাষ্য, উদ্ধারজনিত মামলা কমলেও ডিসেম্বরে ঢাকার-আনাচে পুলিশের উপস্থিতি বেশি থাকার কারণে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা কমেছে। কোনো থানা এলাকায় এই ধরনের মামলা কম হওয়াকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সর্বশেষ অপরাধ সভায় ডিএমপি কমিশনার প্রশ্ন তোলেন, অন্যান্য অপরাধ কমলেও চুরি কমছে না কেন? থানায় মামলা হলেও চোরাই মালপত্র উদ্ধার কিংবা আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। আবার এসব মামলায় কাউকে চার্জশিটভুক্ত না করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
মন্তব্য করুন