চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ হে ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডে বৈঠক করেন। তাঁদের বৈঠকের বিষয় ছিল, মতবিরোধ কমিয়ে আনা ও 'নিকট ভবিষ্যতে সংঘর্ষের কারণ হতে পারে- এমন প্রতিযোগিতা প্রতিরোধ করা'। গত নভেম্বরে দুই দেশের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাতের পর থেকে এটি উভয় দেশের মধ্যকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। যে সময়ে তাঁরা সাক্ষাৎ করেন, এর চেয়ে ভালো সময় মনে হয় আর হয় না, আর হতেও পারে না। বাস্তবতা হলো, বিচ্ছিন্ন হওয়ার জল্পনা-কল্পনার মধ্যেও মার্কিন-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
ব্লুমবার্গে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে এশিয়ার ক্ষমতাধর এই দেশের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের বড় বড় কথা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেকর্ড ভাঙছে। প্রতিবেদনটি বলছে, জাতীয় নিরাপত্তার ঝড় তুলে ওয়াশিংটন উত্তপ্ত হলেও বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতির মধ্যে যে স্থিতিশীল সম্পর্ক রয়েছে, রেকর্ডই তার বার্তা বহন করছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দেওয়া ২০২২ সালের নভেম্বরের তথ্য অনুসারে, গত বছরের আমদানি ও রপ্তানি সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে কিংবা অন্তত তার খুব কাছাকাছি পৌঁছেছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ চিত্র হয়তো আমরা পাব না। তবে বেইজিংয়ের পুরো বছরের পরিসংখ্যানে ৭৬০ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড বাণিজ্যিক ভারসাম্য স্পষ্ট।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের 'বাই আমেরিকান' পরিকল্পনা (কোনো পণ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ আমেরিকান যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ থাকলেই সেটি আমেরিকান পণ্য বলে গণ্য হবে) ও বাণিজ্য সুরক্ষাবাদী নীতি সত্ত্বেও সমস্ত লক্ষণ চীনের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য বাড়ার ইঙ্গিত করছে। এমনকি তাঁর পূর্বসূরি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বারা শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধ এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) চলমান বিরোধ সত্ত্বেও এটি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জ্বলন্ত উদাহরণ হলো, চীনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লাক্সশেয়ার প্রিসিশন অ্যাপলের নতুন প্রিমিয়াম আইফোন তৈরির চুক্তি জিতেছে। এক মাস আগের প্রতিবেদনে আমেরিকান টেক জায়ান্ট কোম্পানির চীন থেকে সম্পূর্ণভাবে চলে যাওয়ার যে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার খবর বের হয়েছিল, সেগুলো পুরোপুরি অসত্য ছিল। মার্কিন কোম্পানিগুলো চীনের বাইরে প্রসারিত হওয়ার জন্য- প্রধানত কিছু ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের প্রতিযোগিতা করছে- এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ খবর। কিন্তু এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, জার্মান অটো ইন্ডাস্ট্রির জায়ান্ট কোম্পানি মার্সিডিজ বেঞ্জ চীনের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। রাজনীতিবিদরা যা-ই বলুন না কেন, কোম্পানিগুলো এশিয়ার দেশ চীনকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে বিবেচনা করছে। মার্সিডিজ বেঞ্জের উৎপাদন বিভাগের প্রধান জোয়েজ বার্জার এই মাসেই ব্লুমবার্গ টিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তাঁর মতে, স্থিতিস্থাপকতা, নির্ভরযোগ্যতা ও কার্বন পদচিহ্নের কারণে অটোমেকার কোম্পানিগুলো তাদের সাপ্লাই চেইন ধরে রাখতে চায়।
বিশ্বায়নের মূল বিষয় হলো দ্বন্দ্ব কমানো। এর মানে, মানুষ যে পণ্য ও পরিষেবা চায়, তা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা কমানো। চীনের তুলনামূলকভাবে সস্তা অথচ দক্ষ যে শ্রমশক্তি রয়েছে, তা কাজে লাগানোর মাধ্যমে আরও অধিক পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। অর্থাৎ গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে চীনের অন্তর্ভুক্তি উৎপাদনের জন্য ভালো এবং সে সম্পদের ব্যবহার সংঘাত কমাতেও সাহায্য করছে। বস্তুত সকল কোম্পানিই এমনটি চায়। এটি তাদের স্বাভাবিক প্রবণতা। তাদের লক্ষ্য হলো, তাদের পণ্য বা পরিষেবা যত বেশি সম্ভব মানুষের হাতে তুলে দেওয়া। এ কারণে রাজনৈতিক পরিকল্পনা অনুসরণ করে কোম্পানিগুলো চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে না। সেটি করলে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন বাধাগ্রস্ত হবে এবং এটি মানুষ, পণ্য এবং পরিষেবার মধ্যে বিশাল রূপক দেয়াল তৈরি করবে।

এমন কিছু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে বিশ্বায়ন তার স্বাভাবিক পথে চলতে পারে না বলেই সাম্রাজ্যবাদী চেতনা জয়লাভ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক আমেরিকান কিউবা বা কোরিয়ার মতো জায়গায় ভ্রমণ করতে চান এবং এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অনেক কোম্পানি তাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখানে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ জয়ী হয়। ইরান ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশের তেলের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে; যদিও পরবর্তীকালে দৃশ্যপট পাল্টানো হয়েছে।


চীনের বিষয়টি ভিন্ন এবং এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক সংঘাত কমানোর ক্ষেত্রে চীন পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় যে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে একশ বছর পিছিয়ে যাওয়া। তাই বলতে গেলে, চীন এখন বিশ্ব অর্থনীতির চাকার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। কেবল কথা দিয়ে এ অবস্থান থেকে তার অপসারণ প্রায় অসম্ভব। তবে এখন না ঘটলেও রাজনীতিবিদরা যা আশঙ্কা করছেন, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুবাইভিত্তিক বৈশ্বিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান ও সিইও সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম, বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব, সম্প্রতি ব্লুমবার্গ টিভিতে বলেছেন, 'আমরা ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা বহন করতে পারি না।' তাঁর মতে, ব্যবসায়ীরা জানেন, কীভাবে তাঁদের ব্যবসা চালাতে হয় এবং কীভাবে অর্থ উপার্জন করতে হয়। তবে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের নেতারা কী করবেন, তা তাঁরা অনুমান করতে পারেন না।
তিনি খুবই স্পষ্ট কথা বলেছেন। কারণ, রাজনীতিকরা যে বিভাজনের কথা বলছেন, সেটি আতঙ্ক ও ভয় তৈরি করতে পারে এবং বাস্তবেও এমনটা ঘটতে পারে। সে কারণেই ওয়াশিংটনের যেসব রাজনীতিক বাণিজ্য নীতি নিয়ে কঠিন ভাষা ব্যবহার করছেন, তাঁদের উচিত সুর নরম করা। যেহেতু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটছে না এবং সত্যি কথা বলতে, কেউ এমনটি চাইছেও না। এ সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় সমস্যা তৈরি হতে পারে।
কীভাবে উভয় পক্ষের মধ্যকার সমস্যা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে সমাধান করা যায়, লিউ হে ও ইয়েলেনের মধ্যকার সাম্প্রতিক বৈঠক তার চমৎকার উদাহরণ। আশা করা যায়, এটি ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যকার কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব কমাতে সাহায্য করবে।

ব্র্যাডলি ব্লাঙ্কেনশিপ: যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক; আরটি ডটকম থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক