শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দুর্নীতির জাল ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে গেছে। শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম 'এক লাখের ঋণ পেতে ঘুষ লাগে ৩০ হাজার'। একজন কৃষককে এক লাখ টাকা ঋণ নিতে যদি ২০-৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়, তাহলে ওই টাকা বিনিয়োগ করে লাভের মুখ দেখার সুযোগ থাকবে? নির্দিষ্ট সময়ে সুদসহ মূল টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হতে হবে। এ ধরনের ঋণ সহায়তার ক্ষেত্রে বলা যায়, খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে পার পাচ্ছে কোনো কোনো রাঘববোয়াল। অন্যদিকে সামান্য টাকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ কৃষককে মাজায় দড়ি বেঁধে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা নিকট-অতীতে আমরা এদেশে দেখেছি।

সমকালে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, 'দালাল ও টাকা না হলে কোনো ঋণ পাস হয় না কুষ্টিয়ার কৃষি ব্যাংকের কোনো শাখায়। প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাতজন করে দালাল আছে কর্মকর্তাদের।' শুধু কুষ্টিয়ায় নয়, সারা বাংলাদেশে কমবেশি এমন ঘুষ বাণিজ্যের খবর মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই। কৃষকের কল্যাণে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় প্রবাসীদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। যাদের জন্য রাষ্ট্রের এ উদ্যোগ তাঁরা কতটুকু উপকৃত হচ্ছেন? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক লোকসান গুনলেও গ্রাহকের কল্যাণে ভর্তুকি দিয়ে চালিয়ে নিতে হচ্ছে। কিন্তু কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে সুফল-বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রাহক।

ব্যাংক কর্মকর্তা দালাল পুষছেন; অথচ তদারকি কর্মকর্তারা এতদিন তা জানতেন না। এখন সংবাদের জন্য মন্তব্য নেওয়ার সময় বলছেন- 'লিখিত অভিযোগ এলে সে অনুযায়ী খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।' লিখিত অভিযোগের অপেক্ষায় থাকতে হলে বড় অঙ্কের বেতন দিয়ে এসব তদারকি কর্মকর্তা রাখার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের নিয়মিত মাঠে যেতে হবে, কৃষকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দরকার হলে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে ঋণ প্রদানে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এসি রুমে বসে লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠনের সনাতন পদ্ধতি বাদ দিতে হবে। দিন তারিখ দিয়ে অডিটে গিয়ে দুর্নীতি ধরা কঠিন; কাগজের মারপ্যাঁচ দুর্নীতিবাজরা ভালো বোঝে। ডিজিটাল বাংলাদেশে ঋণ প্রদানে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রকৃত কৃষকের তালিকা সফটওয়্যারে নিয়ে আসা যেতে পারে। কোনো অকৃষক যেন সেই তালিকায় নাম লেখাতে না পারে সেজন্য তদারকিতে কৌশল নিতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শক্ত অবস্থান নিলে দালাল পোষা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনা কঠিন নয়।

ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় প্রধান কর্তাব্যক্তি হিসেবে একজন ব্যবস্থাপক থাকেন। যেসব শাখার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দালালের মাধ্যমে টাকা নিয়ে ঋণ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সেসব শাখার ব্যবস্থাপকের ভূমিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক খতিয়ে দেখতে পারে। অনিয়মের সঙ্গে তাদের সংশ্নিষ্টতা বা গাফিলতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। প্রচলিত আইনে কঠোর শাস্তির সুযোগ না থাকলে প্রয়োজনে আইনে সংশোধনী আনা যেতে পারে। শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে বহু বছর ধরে চলে আসা অনিয়ম বন্ধ করা যাবে না। ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি করে দালাল ও তাদের দোসর ব্যাংক কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাইরের দালালের পাশাপাশি ব্যাংকের কোনো কোনো স্টাফের বিরুদ্ধে দালালির অভিযোগ এসেছে। অভিযুক্তদের তালিকা করে সম্পত্তির হিসাব নেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি রাজউকের এক পিয়নের বিশাল সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক গাড়িচালকের সম্পত্তি দেখে চমকে উঠতে হয়েছে। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়-এসব কর্মচারীর সিন্ডিকেটের কাছে ভোক্তারা দিন দিন অসহায় হয়ে যাচ্ছে। ছোট চাকরি বলে তাদের আইনের বাইরে রাখার সুযোগ নেই। মূল অভিযুক্ত অর্থাৎ যেসব ব্যাংক কর্মকর্তা ঋণের জন্য টাকা নিয়েছেন তাঁদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করালে কৃষি ব্যাংকের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com