ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

সদিচ্ছা থাকলে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সম্ভব

সমকালীন প্রসঙ্গ

সদিচ্ছা থাকলে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সম্ভব

খুশী কবির

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ২২:৫২

স্বাধীনতার পরপর দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল তাকে অনেকাংশেই একমুখী বলা যায়। শুধু কূটনীতিকদের সন্তানের পড়ালেখার জন্য ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুল ছিল। বাকি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা মাধ্যমে পাঠদান করা হতো। এখনকার মতো বিভাজন সেই সময় ছিল না। কিন্তু ঢাকার পাশাপাশি মফস্বল শহরেও এখন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা চলছে। দেশের অনাচেকানাচে ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। উপজেলা পর্যায়েও অনেক পরিবার তাদের বাচ্চাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে বিব্রতবোধ করে। অথচ যারা আজ সমাজ ও দেশে প্রতিষ্ঠিত তাদের বেশিরভাগের শিক্ষা শুরু হয়েছিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

শিক্ষাব্যবস্থার বিভাজন শুধু বাংলা আর ইংরেজি মাধ্যমকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়নি। সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাসহ নানাভাবে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে। মাদ্রাসারও আবার রকমফের আছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। কী পড়ানো হচ্ছে তার খোঁজ নেই। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসেও দেশের সব মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন বাধ্যতামূলক করা যায়নি। সরকার ভূমিকা নিলে এসব অসংগতি দূর করা কঠিন নয়। সদিচ্ছা থাকলে এখনও একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব।

ইদানীং পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য পরিবেশনের অভিযোগ আসছে। এগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ শিক্ষার্থীদের সামনে কোনো ধরনের ভুল তথ্য উপস্থাপন করা যাবে না। মনের মাধুরী মিশিয়ে অবাস্তব ও কাল্পনিক বিষয়কে বাস্তব হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না। বিশেষ ধারণা চাপিয়ে দেওয়াও উচিত নয়। পাঠ্যবই হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। এর মধ্যে থাকবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ; জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নিশ্চিত করার জন্য যা অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে টিকে থাকা যাবে না। বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী এসে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। আমরা যদি আন্তর্জাতিক মানের কথা ভুলে যাই, সাম্প্রদায়িকতা পাঠ্যবইয়ে নিয়ে আসি, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।

এই ২০২৩ সালে এসেও বলতে হয়, আমরা আগের চেয়ে পিছিয়েছি। মোল্লাতন্ত্রের কাছে নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি জলাঞ্জলি দিচ্ছি। সন্তানদের পঙ্গু করে দিচ্ছি। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি। ডারউইনের তত্ত্ব পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করায় দোষের কী হলো? বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে পরীক্ষিত তত্ত্ব ও তথ্য পাঠ্যবইয়ে সংযোজিত হতেই পারে। এটা মানা না মানা যে কারও ব্যক্তিগত বিষয়। যারা বলছেন, এই তত্ত্বটি স্কুল পর্যায়ে না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেওয়া যেত, তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারছি না। কারণ এই স্মার্টফোন ও ইউটিউবের যুগে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নেটে সার্চ দিয়ে সব দেখছে। তাহলে বৈজ্ঞানিক একটি তত্ত্ব লুকিয়ে রাখার মানে কী? আগেই বলেছি, মানা না মানা ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু জানার সুযোগ দিতে হবে।

আর ডারউইনের তত্ত্বের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে জীব-অণুজীব সম্পর্কিত গোটা বিজ্ঞানজগৎ। এই যে গোটা জীবজগৎকে নানা বর্গ-প্রজাতি ইত্যাদিতে ভাগ করার মাধ্যমে ট্যাক্সনমি নামক বিজ্ঞানের একটা বিভাগ দাঁড়িয়ে আছে এবং এর মাধ্যমে এক প্রজাতির সঙ্গে আরেক প্রজাতির, এক বর্গের জীবের সঙ্গে আরেক বর্গের জীবের মিল-অমিল আবিস্কারের পাশাপাশি মানুষের কল্যাণে সে-বিদ্যা ব্যবহূত হচ্ছে, তার ভিত্তি কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব। সেটিকে বাদ দেওয়া মানে গোটা চিকিৎসাবিজ্ঞানই বাতিল হয়ে যাওয়া!

মোল্লাতন্ত্রের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে বাচ্চাদের চিন্তাশক্তি নষ্ট করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের তথ্যবঞ্চিত করার অধিকার কারও থাকা উচিত নয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করা হলে জাতি কোন দিকে যাবে? প্রতিবেশী ভারত এসব কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে সেখানে অনেক লোক প্রতিবাদ করছেন। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাতের আশঙ্কায় সেই প্রতিবাদ করতে হাজারবার চিন্তা করতে হয়।

ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস। সব মানুষের অধিকার রয়েছে নিজস্ব ধর্ম পালনের। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে কোনো বিষয়ে জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। এর মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমাদের দুর্বলতা দেখানো হচ্ছে। এখন সরকার যদি কতিপয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাপে নতিস্বীকার করে তাহলে শিক্ষার্থীরা অনেক তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তাই পিছুটান দিলে হবে না। মনে রাখতে হবে, যাঁরা ধর্মের দোহাই দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে পশ্চাৎমুখী করতে চান তাঁরা কখনোই দেশের বা জাতির কল্যাণ চান না। এঁদের ভয়ে ভীত হয়ে আমরা কি আফগানিস্তানের পথ ধরব? সেখানে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; নারীদের উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে। আমরাও কি বলব, এ দেশে নারীশিক্ষার দরকার নেই? আমরা অশিক্ষিত জাতি হয়ে যাই? আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পাল্লা দেওয়ার দরকার নেই?

আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, কতিপয় মোল্লা আর সাম্প্র্রদায়িক ব্যক্তির কাছে আমাদের চেতনা জলাঞ্জলি দিতে পারি না। তাই কুসংস্কার ও অপপ্রচারকারীদের শক্ত হাতে প্রতিহত করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য ৩০ লাখ শহীদ রক্ত দিয়েছেন। তাঁদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা যাবে না।

নির্ভুল পাঠ্যপুস্তক নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বর্তমান পাঠ্যক্রম বোঝার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা এত পরে কেন করা হলো। গত বছরের শেষের দিকে করলে ভালো হতো। বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বিজ্ঞানভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যবই প্রণয়ন ও বিতরণ করতে হয়। না হলে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে আমাদের নাগরিকরা মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না।

দেশ ডিজিটাল হয়েছে। আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের খবর নিচ্ছি। প্রযুক্তি সব সহজ করে দিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে প্রযুক্তির সঙ্গে মানানসই। কোনো বিজ্ঞানীর গবেষণা আমরা নাও মানতে পারি। কিন্তু সেটি জানানোর অধিকার থেকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করার অধিকার নেই। আবেগ দিয়ে বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থা চলে না। বিজ্ঞান, যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়। সময়ের ব্যবধানে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কুসংস্কার ও কাল্পনিক চিন্তার বদলে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা ও গবেষণায় জোর দিতে হবে।

খুশী কবির: সমন্বয়ক, নিজেরা করি

আরও পড়ুন

×