নিউইয়র্কভিত্তিক বিনিয়োগবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চ ২৫ জানুয়ারি তাদের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার বিষয়বস্তু এখন সবার জানা। সেখানে ভারতীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে মারাত্মক কিছু অভিযোগ করা হয়েছে; যেগুলোর মধ্যে আছে শেয়ারের দরের পাশাপাশি গোষ্ঠী উপার্জন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অফশোর বিনিয়োগ তহবিল এবং প্রশ্নবিদ্ধ দালালদের ব্যবহার। গুঞ্জন আছে, হিনডেনবার্গের এ প্রতিবেদনের ফলে আদানির গ্রুপের ক্ষতি হবে। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মোট ক্ষতি ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যার মধ্যে গ্রুপের শেয়ারদরে যে বিশাল চার লাখ কোটি রুপির পতন ঘটেছে, তার চেয়েও গভীর হতে পারে।

আদানি গ্রুপ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঋণ নেওয়ার কৌশলও পরিবর্তন করেছে। ২০১৯ সাল নাগাদ এটি দেশীয় ব্যাংকের বাইরে থেকে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা শুরু করে; তখন থেকে তারা বিশেষত বিদেশের বাজারে বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ শুরু করে। ওই বছর আমি গ্রুপটি কীভাবে এহেন ব্যাকরণবিহীন সম্প্রসারণের পেছনে অর্থায়ন করছে, তা বোঝার স্বার্থে গ্রুপের একজন উচ্চপদস্থ ফাইন্যান্স এক্সিকিউটিভের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ওই কর্মকর্তা বলেছিলেন, গত তিন বছরে ব্যাংক তহবিল বেশ সীমাবদ্ধ ছিল। আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরের জন্য, বিশ্ব বন্ড মার্কেট গ্রুপের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থের উৎস হবে। পরবর্তী সময়ে এক ই-মেইল বার্তায়ও কোম্পানির মুখপাত্র একই কথা বলেছিলেন, 'ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর নির্ভরতা কমাতে হলে গ্লোবাল ক্যাপিটাল মার্কেটের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এটা এই গোষ্ঠীর জন্য তহবিলের সবচেয়ে বড় উৎস হতে যাচ্ছে।'

এই সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালেও বিষয়টা বোঝা যায়- ২০২১ সালের অক্টোবরের মধ্যে গ্রুপটি ভারত থেকে অফশোর বন্ডের বৃহত্তম ইস্যুকারী হয়ে ওঠে। সাধারণভাবেই বলা যায়, যে কোম্পানির বন্ড মূল্য হারাচ্ছে, সে কোম্পানির শেয়ার কেনার লোক ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। অথবা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য কোম্পানিকে উচ্চ সুদ দিতে হতে পারে। আদানির জন্য এমন পরিণতি কিন্তু সাধারণ কোনো বিষয় নয়।

আদানি সম্পর্কে আমরা যা জানি তা হলো, ২০১৪ সালের আগে এই গোষ্ঠীর কার্যক্রম মূলত গুজরাটে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই বছরই গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। তার পর থেকে গ্রুপটি রাতারাতি সারাদেশে তার কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে। শুধু তাই নয়; তারা এত দিন যে বিদ্যুৎ ও বন্দর ব্যবসায় সীমাবদ্ধ ছিল; সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বিমানবন্দর, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সিমেন্ট, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়। নতুন এ বাজারগুলোতে বেশ শক্ত একটা অবস্থানও তারা তৈরি করে। ধাঁধার মতো লাগলেও গ্রুপটি ২০১৮ সালেই জানায়, ওই বছর তারা ১ লাখ ৬৭ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করবে, যদিও তখন তাদের নিট মুনাফা ছিল মাত্র ৩৪৫৫ দশমিক ৩৪ কোটি রুপি।

কীভাবে কোম্পানিটি এতটা প্রবৃদ্ধি অর্জন করল? দেখা গেছে, গ্রুপটি নতুন কোম্পানি তৈরি করে পুঁজি সংগ্রহের জন্য শেয়ার ছেড়েছে; সেই টাকা পুরো গ্রুপের পেছনে খরচ করেছে। তারপর আবার নতুন কোম্পানি বানিয়ে শেয়ার ছেড়ে তার অর্থ নতুন কোম্পানি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইক্যুইটি হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। হিনডেনবার্গ বলছে, এসব শেয়ারের মূল্য ছিল বাড়িয়ে ধরা। করছাড় সুবিধাপ্রাপ্ত বিভিন্ন বিতর্কিত পরিচালকের তহবিল পুরোটাই আদানির কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ায়ও এমন প্রতিবেদন বেরিয়েছিল যে, ওই ধরনের বিতর্কিত তহবিল আদানির শেয়ারগুলো চাঙ্গা করার জন্য ব্যবহূত হয়েছিল।


ব্লুমবার্গের কলামিস্ট অ্যান্ডি মুখার্জি লিখেছেন, 'যদি হিনডেনবার্গ সঠিক হয়, তবে বুঝতে হবে যে ভুয়া কোম্পানিগুলোর একটা নেটওয়ার্ক বিদেশে বসে ভারতের বাজারেও সক্রিয়। ভারতের ভেতরে থেকে কিছু কোম্পানি এদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে।' এ প্রক্রিয়া ভারতের নিয়ন্ত্রকরা হয় ধরতে পারছেন না, নয়তো দেখেও না দেখার ভান করছেন। ভারতের পুঁজিবাজারের অন্যান্য অংশেও এ দায়িত্বহীনতা লক্ষণীয়। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ব্রিকওয়ার্ক রেটিং কেলেংকারি আরেকটা উদাহরণ। এটি ইক্যুইটি হিসেবে আদানির ধার করা তহবিলের ব্যবহারকে জায়েজ করেছে। মুখার্জি লিখেছেন, 'একটা বিকশিত বাজারে যেমনটা দেখা যায়, তেমন করেই কোম্পানিগুলো একের পর এক বক্সে টিক মার্ক দিয়ে গেছে। পাশ্চাত্যের মতো এখানেও ওই শর্তগুলো করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য বলে; কিন্তু একটু মাটি খুঁড়লেই যত্তসব কেলেংকারি বেরিয়ে আসে।'

এটাই হলো আসল কথা। দুর্বল নিয়ন্ত্রণ আদানিকে বল্কগ্দাহীন বানিয়েছে। কিন্তু দুর্বল নিয়ন্ত্রকদের পাশাপাশি কোম্পানির নিজস্ব সিদ্ধান্তও খোলাবাজারে শেয়ার বেচাকেনাকারীদের কোম্পানির ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। যারা মনে করে যে কোম্পানির শেয়ার ৮৫% অতিমূল্যায়িত।

এর পরে কী হবে? হিনডেনবার্গ একা কাজ করছে- এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। যেমন এনওয়াইম্যাগ নামক আরেক হিনডেনবার্গের অনুরূপ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নাথান অ্যান্ডারসন কোম্পানির প্রোফাইলে লিখেছেন, 'প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য তার একজন অর্থ জোগানদাতা দরকার হয়, যিনি প্রতিবেদনটি আগেভাগেই দেখতে পারেন। এর ফলে তাঁর পক্ষে কোম্পানিটিতে একটি সংক্ষিপ্ত অবস্থান গ্রহণ সম্ভব হয় এবং হিনডেনবার্গ বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত মুনাফার একটি অংশ নেয়।'

সেই অর্থে, এমন কত কোম্পানির আদানি গ্রুপে অবস্থান আছে, তা আমরা জানি না। নিকোলা কেলেংকারিতে দেখা গিয়েছিল, তারা সাধারণের জন্য বরাদ্দকৃত শেয়ারের ৪৩ শতাংশ দখল করেছিল। দুই বছর পরে ওই কোম্পানির শেয়ারদর ৭১% কমে যায়; খোলাবাজারে কেনাবেচাকারীরা বাজি ধরেছিল, ওই শেয়ারদর আরও কমতে পারে।

এখন আদানি গ্রুপকে বৈশ্বিক বন্ড বাজারের আস্থা ফিরে পেতে হবে বা এর বিকল্প খুঁজতে হবে। কোম্পানিটি হয়তো অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আরও ঋণ নেবে। কিন্তু দ্য মর্নিং কনটেক্সট রিপোর্ট করেছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। গ্রুপটি সার্বভৌম তহবিল জোগাড়ের কথাও বিবেচনা করতে পারে। তবে এটা পরিস্কার নয় যে, এর মাধ্যমে পুরোপুরি বৈশ্বিক বন্ড মার্কেটকে প্রতিস্থাপন করা যাবে কিনা।

যদি বন্ডের দাম খুব কমে যায়, গ্রুপটি পুনরায় সেগুলো অধিগ্রহণ করার কথাও বিবেচনা করতে পারে; তবে এর সম্ভাবনা ক্ষীণ। গত বছর আদানি গোষ্ঠীর মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২ লাখ কোটি রুপি। এর অর্ধেক বিদেশি বন্ড থেকে আসে, যা ১ দশমিক ১ লাখ কোটি রুপি। এত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। যেমন নয় কোম্পানিগুলোর সহজ পরিচালনা নিশ্চিত করা।

এম রাজশেখর: ভারতীয় সাংবাদিক; ভারতীয় নিউজ পোর্টাল দ্য অয়ার থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন