- মতামত
- ব্যাধি চিহ্নিত
ব্যাধি চিহ্নিত
সোমবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির ধারণা জরিপের ফলসমূহে উদ্বিগ্ন হইবার মতো যথেষ্ট উপাদান বিদ্যমান বলিয়া আমরা মনে করি। সোমবার সমকালের প্রতিবেদনে যেমনটা উল্লেখ করা হইয়াছে, গত বৎসর এপ্রিল হইতে জুলাই পর্যন্ত পরিচালিত 'বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশ :উদ্যোক্তা জরিপ ২০২২' শীর্ষক জরিপে দেশের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের ৭৮ শিল্পোদ্যোক্তা অংশগ্রহণ করেন। তাঁহাদের প্রায় ৬৫ শতাংশই মনে করিতেছেন, দেশে ব্যবসায়ের অনুকূল পরিবেশের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা দুর্নীতি। উপরন্তু জরিপে দেখা গিয়াছে, দেশে আমদানি-রপ্তানি সেবার ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়; যাহা গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ, লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ৫৪ শতাংশ এবং কর প্রদানের ক্ষেত্রে ৪৮ শতাংশ। এই কথা বুঝিবার জন্য কাহারও বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই যে, এহেন দুর্নীতির কারণে সংশ্নিষ্ট ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তিতে বাড়তি অর্থ গুনিতে হইয়াছে; যাহার ফলস্বরূপ তাঁহাদের উৎপাদিত বা আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। স্মর্তব্য, ২০২১ সালে পরিচালিত সিপিডির অনুরূপ জরিপেও একই হতাশাজনক চিত্র উঠিয়া আসিয়াছিল। আর মূল্যস্ম্ফীতির চাপ বৃদ্ধিকারী এই সকল ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটিয়াছে, যখন করোনা অতিমারির পরপর বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের বহু দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও নিত্যপণ্য তো বটেই, সকল পণ্যের মূল্যই গগনস্পর্শী; যাহার ক্রমবর্ধমান চাপে ভোক্তাসাধারণ ক্রমশ পিষ্ট হইয়া চলিয়াছে।
এহেন দুর্নীতির কারণে শুধু যে দেশে মূল্যস্ম্ফীতির চাপ বৃদ্ধি পাইয়াছে, উহা নহে; উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কায় আমাদের রপ্তানি পণ্যও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরিয়া রাখিতে হিমশিম খাইতেছে; যাহার অনিবার্য অভিঘাত লাগিতে পারে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকিলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্নথ হওয়ার জন্য অনেকাংশেই দায়ী চলমান ডলার সংকট যে কতটা গভীর হইতে পারে- উহাও ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই। একই কারণে প্রায় দেড় দশক ধরিয়া চলমান উন্নয়নও যে মুখ থুবড়াইয়া পড়িবে- তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। মনে রাখিতে হইবে, দুর্নীতি হইল উন্নয়নের নীরব ঘাতক। বিশ্বব্যাংকও একাধিকবার বলিয়াছে- দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অন্তত ২ শতাংশ হ্রাস পায়। এই সত্য যে সরকারের নিকট অজ্ঞাত- তাহাও নহে। এই কারণেই বিগত নির্বাচনসমূহের প্রাক্কালে প্রদত্ত ইশতেহারে বর্তমান সরকারকে আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষুষ্ণতা প্রদর্শনের অঙ্গীকার করিতে দেখিয়াছি। শুধু তাহাই নহে, বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস সূচকে অন্তত প্রথম ১০০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করিতে কয়েক বৎসর ধরিয়া সরকারের তরফ হইতে নানাবিধ কার্যক্রম দৃশ্যমান, যেখানে ব্যবসায় ক্ষেত্রে দুর্নীতির অবসানকে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসাবে ধার্য করা হইয়াছে। আমরা জানি, শিল্পায়নে পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহ, তৎসহিত প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ নিশ্চিত করিতে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করিতে হইলে উক্ত সূচকে উন্নতির কোনো বিকল্প নাই; যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশেষত বিশ্বে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলির তুলনায় অত্যন্ত শোচনীয়।
দুঃখজনক, সরকারের ঐ সকল অঙ্গীকার ও পদক্ষেপ কার্যক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলিতে পারিতেছে বলিয়া মনে হয় না। হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহিষুষ্ণতা নীতি একান্তই অঙ্গীকার হিসাবে রহিয়া গিয়াছে; নয় তো যাঁহাদের উপর উহা বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছে, তাঁহারা অদক্ষ তো বটেই, আন্তরিকতাশূন্যও হইতে পারেন। এমনও তো হইতে পারে, মাঠবেষ্টনী নিজেই ক্ষেত ভক্ষণ করিয়া ফেলে। অর্থাৎ যাঁহাদের উপর দুর্নীতি প্রতিরোধের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হইয়াছে, তাঁহারা নিজেরাই উক্ত ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমাদের বক্তব্য, ব্যাধি যে শরীরে বাসা বাঁধিয়াছে, তাহা সিপিডির উক্ত জরিপ স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে। এখন ব্যাধির কারণসমূহ সরকারকে নির্ণয় করিতে হইবে এবং রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক হিসাবে উহার প্রতিকারও তাহাকে করিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে বিলম্ব করিবার ফুরসত নাই। কারণ দুর্নীতি প্রতিরোধে যে কোনো প্রকার বিলম্ব অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অদ্যাবধি যতটুকু অর্জন করিয়াছে, তাহা ব্যর্থ করিয়া দিতে পারে।
বিষয় : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন