
বাঁ থেকে- জওহরলাল নেহরু, লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
ভারতের ইতিহাসের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, হাজার হাজার বছর ধরে বাইরে থেকে বিশাল আকারে বিভিন্ন জাতির লোক যেভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে, এ রকম অন্য কোনো দেশে হয়নি। এই বিদেশিরা ভারত আক্রমণ ও লুটপাট করে নিজেদের দেশে ফিরে যায়নি। তারা এ দেশে এসে থেকে গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম- গ্রিসের আলেকজান্ডার, গজনির সুলতান মাহমুদ এবং ইরানের নাদির শাহ্। কিন্তু সামান্য ব্যতিক্রম সত্ত্বেও বলা যায়, আক্রমণকারী এই বিদেশিরা এ দেশ লুটপাট করে ফিরে যাওয়ার জন্য ভারত আক্রমণ করেনি। মধ্য এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এসেছিল এবং বিপুল সংখ্যায় ভারতে থেকে গিয়েছিল। সুদূর প্রাচীনকালে যে আর্যরা ভারত আক্রমণ করে এ দেশে এসে বসবাস শুরু করেছিল, সেই বিদেশিরাই পরবর্তীকালে হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির মূল নির্মাতা। আর্যদের বাদ দিয়ে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি চিন্তাই করা যায় না। আর্যদের পর ধারাবাহিকভাবে শক, হুন থেকে নিয়ে আরব, ইরানি, তুর্কি, পাঠান, মোগল পর্যন্ত ভারতে এসেছে এবং এখানে থেকে গেছে।
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা আবিস্কারের পর ইউরোপীয়রা সেসব দেশ দখল করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেও, তার সঙ্গে ভারতে বিদেশিদের বসবাস ছিল একেবারে অন্য রকম। ইউরোপীয়রা আমেরিকার আদিবাসীদের ব্যাপকভাবে হত্যা করে প্রায় নিশ্চিহ্ন ও একঘরে করেছিল। নতুন আমেরিকার শাসন ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাদের কোনো অবস্থান থাকেনি। তা ছাড়া তাদের থেকে ইউরোপীয়দের সংস্কৃতি ছিল অনেক উচ্চ স্তরের। আর্যরা ভারতে এসে যে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস করেছিল, সেটি ছিল আর্যদের সভ্যতা থেকে অনেক উচ্চ স্তরের। আর্যরা ছিল পশুপালক ও যাযাবর। তাদের সংস্কৃতি ছিল মূলত পশুপালকদের সংস্কৃতি, যার সঙ্গে প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল। যদিও তা ঘটতে সময় লেগেছিল। এমনভাবে এই সংমিশ্রণ ঘটেছিল, যাতে আর্য সভ্যতা পরিণত হয়েছিল ভারতীয় সভ্যতায়। বলতে গেলে, এখন প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, তার ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল আর্যদের দ্বারা। এক হিসাবে বলা চলে, আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর্যপূর্ব ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অনেকাংশে আত্মসাৎ করেছিল। ভারতের হিন্দু সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, তা বিদেশি আর্যরাই নির্মাণ করেছিল।
আর্যদের পর শক, হুন, আরব, ইরানি, তুর্কি, পাঠান, মোগলরা ভারত আক্রমণ ও দখল করেছে এবং ভারতে থেকে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, তারা এক দেহে লীন হয়েছে। এভাবে বহিরাগতরা ভারতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকার সময় তারা ভারতীয় জনগণকে শত্রু মনে করে তাদের থেকে নিজেদেরকে একেবারে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করেনি। উপরন্তু নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে তারা ভারতীয়দের সঙ্গে যথাসাধ্য একাত্ম হতে চেষ্টা করেছে। তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে ঐক্যের মধ্যেই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং মঙ্গল দেখতে চেয়েছে।
আরব, তুর্কি, পাঠান, মোগলসহ যেসব জাতি ভারতে এসেছিল এবং এ দেশ শাসন করেছিল, তাদের সঙ্গে অবশ্য পূর্ববর্তী প্রবেশকারীদের একটি বড় পার্থক্য ছিল। ভারতে থেকে ভারতীয় হয়ে গেলেও তারা নিজেদের ধর্ম পরিত্যাগ করেনি তাদের পূর্ববর্তীদের মতো। তারা ছিল ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং এদিক দিয়ে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিল। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকলেও ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম উভয়েই পরস্পর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য।
ধর্মীয়ভাবে স্বতন্ত্র হলেও মুসলমান শাসকরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করে নিজেদের অবস্থান নিরাপদ ও শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন। প্রথমে সুলতানি আমল ও পরে মোগল-পাঠান আমলে এই প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। আলাউদ্দীন খিলজী ও পরে আকবর সাম্রাজ্যিক প্রয়োজনেই ইসলাম ধর্মের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক শিথিল করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন তৈরি করতে চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি আওরঙ্গজেব হিন্দুবিদ্বেষী হলেও এবং কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করলেও তিনি আবার অনেক হিন্দু মন্দিরে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন এবং তাঁর প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে হিন্দুরা ছিলেন। হিন্দু-মুসলমানকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর কোনো চেষ্টা আওরঙ্গজেবের ছিল না। মোগল আমলের শেষ পর্যন্ত এই নীতি অব্যাহত ছিল।
ইউরোপে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটতে থাকার সময় থেকে, বলা চলে ১৭ শতক থেকে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্যের জন্য আসতে থাকে। ১৮ শতকে তারা ভারতে নিজেদের খুব শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলে। এর মধ্যে ইংরেজরাই ছিল প্রধান এবং ভারতের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে তারা বাণিজ্যের প্রয়োজনেই নিজেদের সামরিক শক্তি গড়ে তোলে। বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষের কারণেও এভাবে সামরিক শক্তি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল। এদিক দিয়ে ইংরেজ এবং তার সঙ্গে ফরাসিরাই ছিল অগ্রগণ্য।
১৮ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মাদ্রাজ ও বাংলায় ইংরেজরা নিজেদের বাণিজ্যিক কুঠিকে কেন্দ্র করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে তার জোরে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সম্প্রসারিত করতে থাকার সময় বাংলায় নবাবি শাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। মাঝে মাঝে সামরিক সংঘর্ষ হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা স্বাধীন নবাবকে পরাজিত করে তাদের তাঁবেদার নবাবদের একের পর এক ক্ষমতায় বসিয়ে বাংলা শাসন করতে নিযুক্ত হয়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় ও পরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে নিজেদের শাসন প্রবর্তন করে। সে শাসন ১৮৫৭ সালে সিপাহি অভ্যুত্থান পর্যন্ত বজায় ছিল। সিপাহি অভ্যুত্থানের পর ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির শাসন উচ্ছেদ করে ভারতে সরাসরি নিজের শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী যেসব জাতি ভারতে এসেছিল, তারা এ দেশে বসবাসের উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিল। তারা ভারতে থেকে গিয়েছিল স্থায়ীভাবে। কিন্তু ইউরোপীয়দের ভারতে আসার উদ্দেশ্য ছিল অন্য রকম। তারা এসেছিল বাণিজ্যিক মুনাফার স্বার্থে। ইংরেজরা যখন বাংলায় ক্ষমতা দখল করে, সেটা ছিল ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার সময়। তারপর বাংলা ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চল পরিণত হয় ইংল্যান্ডের উৎপাদিত শিল্পপণ্যের বাজারে। শুরু হয় ব্যাপক বাজারি লুণ্ঠন। এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হতে থাকে পুঁজি, যা ইংল্যান্ডের শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে বড় আকারে অবদান রাখে।
১৭৫৭ সালে বাংলায় ক্ষমতা দখলের পর ইংরেজরা নিজেদের কর্তৃত্বাধীন প্রশাসন গঠন করতে নিযুক্ত হয়। তারা ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বাংলায় প্রবর্তন করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই বন্দোবস্ত শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে। বলা চলে, ১৯ শতকে অনেকাংশে এই ব্যবস্থার অধীনেই গড়ে ওঠে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। পরবর্তীকালে তারা আরও সুগঠিত হয়ে শুধু বাংলা নয়; সামগ্রিকভাবে ভারতের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। প্রশাসনিক প্রয়োজনে তারা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করে তার আধুনিকীকরণ ঘটায়। প্রথম দিকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ফারসি প্রশাসনিক ভাষা থাকলেও উনিশ শতকের গোড়া থেকেই তারা ইংরেজি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব প্রদান করে।
ইংরেজ কোম্পানির শাসনে ইংরেজি শিক্ষা থেকে নিয়ে অন্য যেসব সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হলো, হিন্দুরা তা পুরোপুরি গ্রহণ করল। তবে মুসলমানরা বিভ্রান্তিবশত নবাবি-মোগল শাসনকে নিজেদের শাসন মনে করে। তার অবসানের পর ইংরেজ শাসনকে বৈরী শাসন মনে করে তাদের দ্বারা সৃষ্ট সুযোগ-সুবিধা ও সেই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে অনাগ্রহী হয়। ইংরেজ-পূর্ববর্তী শাসনে উচ্চ শ্রেণির মুসলমানসহ অনেকে প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি করত। সেটিই ছিল তাদের অবস্থানের শ্রেণিগত ভিত্তি। সেই ভিত্তি অপসারিত হওয়া এবং মোগল ও নবাবি আমলেও ভূস্বামী ও জমিদার হিসেবে তাদের কোনো অবস্থান না থাকায় তারা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তারা বিপুল সংখ্যায় দরিদ্র হয়ে যায়। তার ওপর ইংরেজ শাসনে ইংরেজি শিক্ষা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বর্জন করায় তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়। হিন্দুদের থেকে শিক্ষাদীক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে তারা অনেক পিছিয়ে পড়ে।
মুসলমানদের এই পিছিয়ে পড়া অবস্থা একশ বছর ধরে চলার পর সিপাহি অভ্যুত্থানের পরবর্তী পর্যায়ে মুসলমানরা উপলব্ধি করে- ইংরেজদের শিক্ষাদীক্ষা বর্জন করা ছিল বড় রকম ভ্রান্তি। এই ভুল সংশোধন করতে তারা উদ্যোগী হলো। এ সময় ভারতে কোম্পানির শাসনের অবসান হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যিক সরকারের শাসন। তারা মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার প্রতি মনোযোগ দেয়; কিছু সুযোগ-সুবিধারও ব্যবস্থা করে। এতে তাদের কিছু কর্মসংস্থান হতে থাকে।
হিন্দুরা এত দিন প্রায় নিরঙ্কুশভাবে শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছিল। এর পর মুসলমানরা এ ক্ষেত্রে আবির্ভূত হলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। হিন্দুরা মনে করে, তারা এত দিন যে সুযোগ-সুবিধা একচেটিয়া ভোগ করে আসছিল, তার পরিবর্তে তাদেরকে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাদের ভাগ থেকে একটা অংশ মুসলমানদের দিতে হচ্ছে।
এর ফলে ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের একটা দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে এই সময়ে। ষাটের দশকে নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসুর নেতৃত্বে হিন্দু মেলা নামে এক সম্মিলনীর আয়োজন হয়, যেখানে ঘোষণা করা হয়- হিন্দুরা এক স্বতন্ত্র জাতি। এই জাতিতত্ত্বের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের মুসলমান থেকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করা। পরে বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে দাঁড়ালেন এই জাতিতত্ত্বের এক প্রবল প্রবক্তা। মুসলমান সমাজের নেতা হিসেবে বাংলায় নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলী এবং উত্তর প্রদেশে স্যার সৈয়দ আহমদ আবির্ভূত হন। তাঁরা মুসলমানদের অগ্রগতির জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে দেনদরবার করেন। এই চেষ্টা চালালেও তাঁরা অবশ্য মুসলমানদের কোনো পৃথক জাতি হিসেবে উপস্থিত বা ঘোষণা করেননি। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের 'লাহোর প্রস্তাব' গৃহীত হওয়ার সময়েই মুসলমানদের দ্বি-জাতিতত্ত্ব প্রথম সূত্রায়িত হয়।
১৯ শতকে 'সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটির প্রচলন হয়নি। ২০ শতকে ব্রিটিশরাই হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বকে প্রথম সাম্প্রদায়িক হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির প্রচলন না হলেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ নিহিত ছিল। পরে হিন্দু-মুসলমানের এই প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি ২০ শতকের গোড়া থেকেই বিকশিত হয়ে ত্রিশ-চল্লিশের দশকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল। শুধু তাই নয়; রাজনীতির এক নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে ব্রিটিশ সরকার চেষ্টা করে। সিপাহি অভ্যুত্থানের পর মুসলমানদের শিক্ষার জন্য উৎসাহ প্রদান এবং তাদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদেরকে হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার পর্যায়ে উঠিয়ে এনে তাদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি। তাদেরকে বিভক্ত করে নিজেদের শাসন অনেকটা বিপদমুক্ত ও মসৃণ করার চিন্তা থেকেই তারা এই নীতি গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে তাদের এক উপায় হয় ইতিহাসচর্চা। বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ জেমস মিল তাঁর বিখ্যাত 'দ্য হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' বইতে ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু, মুসলমান ও ব্রিটিশ- এই তিন ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম দুই কাল-পর্বকে ধর্মের ভিত্তিতে নামকরণ করলেও ব্রিটিশ শাসনকে খ্রিষ্টান না বলে তিনি ব্রিটিশ আখ্যা দেন। আগে ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতের ইতিহাসকে এভাবে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার ব্যাপার না থাকলেও জেমস মিল একজন সাম্রাজ্যবাদী ও ইতিহাসবিদ হিসেবে সেটা করে ভারতে সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশ ঘটানোর শর্ত সৃষ্টি করেন। তাঁর এই চেষ্টা বিফল হয়নি। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়রা যে ইতিহাসচর্চা করেছিল, সেটা অনেকাংশেই জেমস মিলের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে গঠিত হয়েছিল এবং ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।
১৯ শতকের বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের আপেক্ষিক অবস্থার মধ্যে পার্থক্য ২০ শতকের রাজনীতিতে সংকট সৃষ্টি করেছিল। এ জন্য ১৯ শতকের অবস্থা পর্যালোচনা ও বিবেচনা ছাড়া ২০ শতকের রাজনীতি বোঝা সম্ভব নয়। ১৯ শতকে চাকরির জন্য হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছিল, ২০ শতকে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ক্ষমতার জন্য পুঁজিবাদীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি। এর পরিণতি পেয়েছিল ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে।
পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। এই সংঘাত যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ও যুদ্ধ বাধায়। কিন্তু কোনো দেশের অভ্যন্তরে পুঁজির বিভিন্ন অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ সৃষ্টি করে না। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের মধ্যে। কোনো দেশের নিজেদের পুঁজির বিভিন্ন অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ছিল না। কিন্তু ভারতে হিন্দু ও মুসলমান পুঁজি দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব ছিল। এর ফলে পুঁজির সংঘর্ষের একটা রূপ ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দেশে দেশে ছিল যুদ্ধ আর ভারতের অভ্যন্তরে ছিল দাঙ্গা। দাঙ্গার ভূমিকা ভারতের রাজনীতিতে ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হতে সময় লেগেছিল। ১৯২৭ সালের আগে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার দাবি করেনি। তারপর স্বাধীনতার যে সংগ্রাম শুরু হলো, সেটা ব্রিটিশ সরকারকে শত্রু নির্ধারণ করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ছিল না। সেটা ছিল ভারতে ব্রিটিশের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো। এমনকি অনেকটা আবেদন-নিবেদনের মতো, যাকে মওলানা মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন- 'বেগিং অ্যান্ড প্রেয়িং পলিটিকস'।
(আগামীকাল সমাপ্য)
বদরুদ্দীন উমর :লেখক ও তাত্ত্বিক; সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
মন্তব্য করুন