এই প্রজন্মের খুব কম লোক আছেন, যাঁরা শামসুল হককে চেনেন। অথচ এক সময়ে তিনি ছিলেন এ দেশের রাজনীতির উজ্জ্বল তারকা; পরাধীন বাংলার তরুণ সমাজের কাছে আলোর দিশারি।

বিগত শতাব্দীর মধ্য-চল্লিশ থেকে মধ্য-পঞ্চাশে যে তরুণ তুর্কিরা রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় তুলেছিলেন, শামসুল হক তাঁদের অন্যতম। ১৯১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের দরিদ্র কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। তখন বাংলার মুসলমানের সিংহভাগই কৃষিজীবী। কিন্তু চাষের জমি ছিল জমিদারদের দখলে। জমিদারের অত্যাচার আর শোষণের খড়গের নিচেই শামসুল হকের বেড়ে ওঠা। অত্যন্ত মেধাবী এই কিশোর গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে টাঙ্গাইল শহরে জায়গির থেকে লেখাপড়া করতেন। তখন শুরু হয়েছিল প্রজাদের 'জমি যার, লাঙ্গল তার' আন্দোলন। ভূমিস্বত্বের দাবিতে গ্রামে গ্রামে প্রজা সমিতি গড়ে ওঠে। স্কুলপড়ূয়া শামসুল হক সেই সংগঠন-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির কর্মী।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম আসনে বিজয়ী কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ মিলে যুক্ত সরকার গঠিত হয়। হক সাহেবও মুসলিম লীগে যোগ দেন। তখন মুসলিম লীগের উদরে কৃষক প্রজা পার্টি ঢুকে পড়ে। 'বাংলার বাঘ' হয়ে পড়েন সর্বস্বান্ত। কৃষক প্রজা পার্টির কর্মী বাহিনীর বেশিরভাগই মুসলিম লীগে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৪০ সালে শামসুল হকও মুসলিম লীগে যোগ দেন।

মুসলিম লীগে তখন দুটি ধারা। একদিকে আকরম খাঁ-নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে নবাব-জমিদার শ্রেণি। অপরদিকে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মধ্যবিত্তের দল। শিক্ষিত তরুণরাই এই অংশের মূল শক্তি।
তরুণদের মুসলিম লীগের পতাকাতলে জমায়েত হওয়ার পেছনে কোনো ধর্মীয় উন্মাদনা ছিল না। ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির আকুতি। রায়তদের জন্য জমি আর শিক্ষিত যুবকদের চাকরির স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবকরা মুসলিম লীগে শামিল হয়েছিলেন। অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলনের মধ্যে যে মুসলিম তরুণরা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন; ত্রিশের দশকে তাঁরাও কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হন। এই যুবকরা অসাম্প্রদায়িক; হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক। তাঁদের পদচারণায় বাংলায় মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী দলে পরিণত হয়।

আবুল হাশিম নিখিল বাংলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টির আদলে পার্টি হাউস গড়ে তোলেন। নূরুদ্দিন আহমেদ, সালেহ আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, জহির উদ্দিন প্রমুখ কলকাতা কেন্দ্রের যুব মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। ঢাকা কেন্দ্রের কাণ্ডারি শামসুল হক। আরও ছিলেন কামরুদ্দিন আহমেদ, শওকত আলি, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, খন্দকার মোশতাক, কাজী মোহাম্মদ বশীর প্রমুখ। শামসুল হকের দক্ষ পরিচালনায় ঢাকা কেন্দ্রে কর্মীরা দেশময় ছড়িয়ে পড়েন। মুসলিম লীগ মধ্যবিত্তের দলে পরিণত হওয়ার পেছনে তাঁর অবদান অনন্য।

শামসুল হক ছিলেন দক্ষ সংগঠক। ১৯৪৬ সালে ময়মনসিংহের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সিলেটের গণভোটেও গিয়েছিলেন। জ্বালাময়ী বক্তৃতা করতেন। তাঁর বক্তৃতা শুনতে সভায় দূর-দূরান্ত থেকে শত শত লোক ছুটে আসত। দেশভাগের প্রাক্কালে সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখের নেতৃত্বে যখন স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়; এর পক্ষে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন। এমনই একটি প্রচারাভিযানে তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন রাজনীতিবিদ ও লেখক কামরুদ্দিন আহমেদ। তিনি দেখলেন- ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে 'স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ' ধ্বনি দিতে দিতে লোকজন সভাস্থলে আসছে।

১৯৪৭ সালে যখন সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে হতাশার সুর; পূর্ব বাংলার নেতৃত্বও চলে গেছে নবাব-জমিদারদের মুঠিতলে; সোহরাওয়ার্দী মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কলকাতায় শান্তি মিশনে; স্বাধীন বাংলা গঠনে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে আবুল হাশিমও বর্ধমানের নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন- এই অবস্থায় শাসমুল হকের আহ্বানে ঢাকার ১৫০, মোগলটুলীতে সারাদেশের প্রগতিশীল মুসলিম লীগের কর্মীরা একত্র হন। শামসুল হকের চিঠি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমানও গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন, যা তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে রয়েছে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নবধারা সৃষ্টি হয়। শামসুল হক এর আহ্বায়ক হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন রাজনীতিতে আরেক ধাপ অগ্রগতি।

ভাষা আন্দোলনে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, কমিউনিস্ট কর্মী- সবাই এক মিছিলে শামিল হন। শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, কামরুদ্দিন, তাজউদ্দীন প্রমুখের সঙ্গে শামসুল হক ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেলে গিয়েছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক।

প্রগতিশীল কর্মীদের আশাবাদী করেছিল ১৯৪৯ সালের টাঙ্গাইল উপনির্বাচন। একদিকে করটিয়ার জমিদার খুররুম খান পন্নী, অপরদিকে শামসুল হক- এক গরিব কৃষকের সন্তান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে লিখেছেন, 'আমরা ঠিক করলাম শাসমুল হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে। শামসুল হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন, কিন্তু টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? হক সাহেবের টাকা নাই, আর আমাদেরও টাকা নাই। তবু যেই কথা, সেই কাজ। শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইল চলে গেলেন, আমরা যে যা পারি জোগাড় করতে চেষ্টা করলাম। কয়েকশ টাকার বেশি জোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠল না। ছাত্র ও কর্মীরা ঘড়ি ও কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দিয়েছিল।' সেই নির্বাচনে শামসুল হক বিপুল ভোটে পন্নীকে পরাজিত করেন। এই সাফল্য ছিল ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের প্রেরণা। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়। কারারুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় যুগ্ম সম্পাদক।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের হাওয়া বইতে শুরু করে, সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের কর্মীরা সে হাওয়ায় উদ্দীপ্ত; তখন শামসুল হক তাঁর গুরু আবুল হাশিমের পথ ধরে রব্বানিয়াত দর্শনের চর্চায় মনোনিবেশ করেন, যা তাঁকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়; স্বপ্নচারী করে তোলে। কারাগারে থাকাকালে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেল থেকে বেরিয়ে তিনি নিজেকে দুনিয়ার খলিফা দাবি করেন। এভাবেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটে। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও দূরত্ব বেড়ে যায়। স্ত্রী আফিয়া খাতুন ছিলেন ইডেন কলেজের ইংরেজির শিক্ষক। প্রেম করে তাঁরা ঘর বেঁধেছিলেন। এক সময় সেই বন্ধন টুটে যায়। তিনি শিশুকন্যাদ্বয়কে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান।

শামসুল হককে কয়েকবার মানসিক হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়। কিন্তু তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেননি। পথে পথে ঘুরেছেন। রব্বানিয়াত দর্শনে নতুন দল করার কথা বলেছেন। তারপর এক সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান।
শামসুল হকের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৪ সালে তিনি একবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তারপর তাঁরা আর কিছু বলতে পারেন না।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে তাঁর কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। শোনা যায়, ১৯৬৫ সালে যমুনাপাড়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জেলেরা অসুস্থ শামসুল হককে উদ্ধার করে কালিহাতীর এক স্থানীয় বাজারে নিয়ে আসেন। ওই এলাকার এক কংগ্রেস নেতা তাঁকে চিনতে পারেন। নিজ বাড়িতে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তাঁকে আর সুস্থ করা সম্ভব হলো না। মৃত্যুর পর যমুনাতীরে তাঁকে দাফন করা হয়। নানা বিবেচনায় সেই খবর গোপন রাখা হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বজন-সুহৃদরা ১ ফেব্রয়ারি এই বিস্মৃত নায়কের জন্মদিনে হাজির হন; সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য দেন। তবে তাঁর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ, রাজনৈতিক অঙ্গন, নাগরিক সমাজ নির্বিকার।

আবু সাঈদ খান :উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল