
ইসলামে নৈতিক চরিত্র গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে নবী-রাসুলদের প্রেরণ করে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়েছেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পৃথিবীতে পাঠানোর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা। নবীজি (সা.) বলেন, 'আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তেই পাঠানো হয়েছে।' একদা জনৈক ব্যক্তি রাসুলে পাক (সা.)-কে দ্বিনের সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন, 'উত্তম চরিত্র।' এ কথা দ্বারা বোঝা যায়, উত্তম চরিত্র দ্বিনের অন্যতম স্তম্ভ, যা ছাড়া দ্বিনের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বোত্তম চরিত্রের মাধ্যমেই অন্ধকার সমাজকে আলোয় ভরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা পুরো বিশ্বমানবতার নৈতিক চরিত্র গঠনে অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে।
আল্লাহতায়ালা সুরা কলমের ৪ আয়াতে এরশাদ করেন, 'হে রাসুল, অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।' তাই উত্তম চরিত্র গঠনের সর্বোত্তম উপায় হলো, মহানবী (সা.)-এর সুন্নত অনুসরণ করা। আল্লাহতায়ালা সুরা আহযাবের ২১ আয়াতে এরশাদ করেন, 'নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।'
হাদিস শরিফে উত্তম চরিত্রকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, 'তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।' (বুখারি)
আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসুল (সা.) আমাদের যেসব উত্তম চরিত্র অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন, সত্যবাদিতা তার অন্যতম। আল্লাহতায়ালা সুরা তওবার ১১৯ আয়াতে এরশাদ করেন, 'হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।'
উত্তম চরিত্রের আরেকটি দিক আমানতদারি। আল্লাহতায়ালা সুরা নিসার ৫৮ আয়াতে এরশাদ করেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন- আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দাও।' আর এ গুণের কারণেই মহানবী (সা.) তাঁর সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আল-আমিন বা বিশ্বস্ত উপাধি পেয়েছিলেন।
মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা উত্তম চরিত্রের অন্যতম দিক। আল্লাহতায়ালা সুরা নিসার ৩৬ আয়াতে এরশাদ করেন, 'আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করো না এবং মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।' ওয়াদা পূরণ করা উত্তম চরিত্রের আরেকটি দিক। এর প্রতি ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা সুরা বনি ইসরাইলের ৩৪ আয়াতে এরশাদ করেন, 'আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। কেননা, অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে।'
কথাবার্তা ও মৌখিক আচরণে একজন মুমিনকে কীভাবে শালীন হতে হবে, সে ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার ৮৩ আয়াতে এরশাদ করেন, 'মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথাবার্তা বলো।'
যেসব কাজ ও গুণাবলি মানুষকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী করে গড়ে তুলবে তা হচ্ছে- সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারি, দানশীলতা, ধৈর্য, কাউকে কষ্ট না দেওয়া, অযথা কারও প্রতি রাগান্বিত না হওয়া, কারও প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ না করা, রাগ নিয়ন্ত্রণ করা, বিনয়ী হওয়া, মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করা, অপরের কল্যাণে সবসময় আন্তরিক থাকা।
চরিত্রবান ব্যক্তিরা মহান আল্লাহর কাছ থেকে যেসব পুরস্কার লাভ করবেন তা হলো :কেয়ামতের মাঠে হিসাবনিকাশের সময় আল্লাহ ভীতি ও সচ্চরিত্রের গুণ মুমিনের আমলনামাকে ভারি করবে। মুমিনরা সবাই ইমানদার হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে গুণগত দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে। একদা জনৈক ব্যক্তি রাসুলে পাক (সা.)-কে উত্তম ইমানদার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে যে অধিক চরিত্রবান, সে-ই উত্তম।
মুমিনরা কেয়ামতে রাসুলে পাক (সা.)-এর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে সবাই এক রকম হবে না। এ প্রসঙ্গে রাসুলে পাক (সা.) বলেন, 'কেয়ামত দিবসে তোমাদের মধ্যে আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় ও অবস্থানের ক্ষেত্রে অধিক নিকটবর্তী হবে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী লোকরাই।'
রাসুলে পাক (সা.) নিজে গুণাহমুক্ত হয়েও নিজের চরিত্র সুন্দর করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। তিনি দোয়ায় বলতেন, 'আল্লাহ, তুমি আমার গঠন আকৃতি সুন্দর করেছ; আমার চরিত্রকেও সুন্দর করে দাও।'
নৈতিকতার উত্তম নিদর্শন সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, বান্দাহ ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকি হিসেবে গণ্য হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে কোনো মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেসব কাজও পরিত্যাগ করবে, যাতে কোনো দোষ বা মন্দ নেই।'
দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। কিছুদিন বসবাস করার পর পরপারে চলে যেতে হবে। একমাত্র উত্তম চরিত্র ছাড়া আর কিছুই আমাদের সঙ্গী হবে না। অর্জিত ধন-দৌলত, গাড়ি-বাড়ি, সন্তান-সন্ততি কিছুই সঙ্গে যাবে না। তাই আমাদের উচিত মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করা, কম হাসা, অধিক পরিমাণে কাঁদা, পরনিন্দা থেকে বিরত থাকা, নিয়মিত আত্মসমালোচনায় নিয়োজিত থাকা, সুশিক্ষা অর্জন এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা, দ্বীন ইসলামের প্রচারে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা।
মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে পবিত্র কোরআন ও রাসুলে পাক (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী উত্তম চরিত্র গঠনের তৌফিক দান করুন।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
মন্তব্য করুন