
বাঙালি মুসলমান ১৯৪৬ সালে পাকিস্তানের পক্ষে যে ভোট দিয়েছিল, তার পেছনে অনুপ্রেরণাটি পাঞ্জাবি শাসিত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ছিল না। তা ছিল সার্বিক স্বাধীনতার। তারা শাসক পরিবর্তন চায়নি; চেয়েছিল নিজেদের মুক্তি। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র তাদের মুক্তি দেবে- এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। অভাব ও বঞ্চনা দুটিই রয়ে গেল; আগে যেমনটা ছিল। বোঝা গেল যে, ব্রিটিশের উপনিবেশ থেকে কোনোমতে বেরিয়ে এসে পূর্ববঙ্গ নতুন এক উপনিবেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মানুষের ক্ষোভ এবং ক্রমবর্ধমান হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। বিভিন্ন আন্দোলনে মধ্যবিত্ত ছাড়াও কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ যোগ দিতে থাকে। আন্দোলনের প্রকাশ্য দাবি যা-ই থাক; নেপথ্যের আকাঙ্ক্ষা ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে এসেছিল পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবি; যে স্বায়ত্তশাসন স্বৈরশাসকরা দিতে চায়নি। অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিটাও স্বায়ত্তশাসন লাভের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই যুক্ত ছিল বৈকি। স্বাধীনতার কথা তখন মোটেই ভাবা হয়নি। কেউ কেউ হয়তো ভেবেছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে বলবেন, এমন সুযোগ ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা করেছিল- 'ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।' অর্থাৎ এই স্বাধীনতা ভুয়া। কারণ লাখ লাখ মানুষ অনাহারে। কথাটা মিথ্যা ছিল না। অসংখ্য মানুষ অভুক্ত ছিল। আর মানুষ যদি খেতেই না পেল, তাহলে কীসের স্বাধীনতা; কোথায় মুক্তি?
অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সাধারণ মানুষ বুঝে নিয়েছিল যে, তারা নব্যপরাধীনতার জালে আটকা পড়েছে। তারা তাই শুধু স্বায়ত্তশাসনই নয়; স্বাধীনতার জন্যও উন্মুখ হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের ছয় দফায় পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ছিল না; পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিই ছিল। কিন্তু ঊনসত্তরের জনঅভ্যুত্থানের পর মানুষ স্বাধীনতাই চেয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে রায়টা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে ছিল না, যদিও আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবেই ছিল সামনে। জনগণের রায়টা ছয় দফাকে অতিক্রম করে গিয়ে পরিণত হয়েছিল এক দফায়। অর্থাৎ স্বাধীনতার দাবিতে। সত্তর সালের ওই রায়ের পর একাত্তর সালে যে মুক্তিযুদ্ধ ঘটবে- এটা ছিল একেবারেই অনিবার্য এবং সেটাই ঘটেছে। যুদ্ধ হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়েছে।
অথচ ১৯৪৭ সালে কে ভেবেছিল- বাংলাভাষী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে? না; কেউ সেটা ভাবেনি। সম্ভব ছিল না ভাবা। কিন্তু সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাই তো ঘটল। কেন ঘটল? না, কোনো অলৌকিক কারণে ঘটেনি। কারও করুণার দরুন এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। আপাত অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা সম্ভব হয়েছে জনগণের সংগ্রামের কারণে। তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার কারণে।
এটাও মনে রাখতে হবে, মুক্তির লড়াইটা নতুন নয়। এই উপমহাদেশে তার সূত্রপাত ১৮৫৭-এর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, যার অগ্রসরমানতার ধারাবাহিকতাতেই আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের জনঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। জনগণ এবং কেবল জনগণই পারে এমন ঘটনা ঘটাতে। দেশে দেশে কালে কালে তারা এমন কাজ করেছে; করল বাংলাদেশেও। কিন্তু তারপর?
আগের শাসকরা বিদেশি ছিল। এখানকার শাসকরা দেশি হয়েও স্বদেশি নয়; তাদের আচরণ আগেকার শাসকদের মতোই। '৪৭-এর স্বাধীনতার পর পাঞ্জাবি শাসক শ্রেণি বাঙলির প্রতি যে আচরণ করেছে; একাত্তরের স্বাধীনতার পরে বাঙালি শাসক শ্রেণির আচরণ যে তা থেকে একেবারেই ভিন্ন- মোটেই নয়। শাসক ও শাসিতের ভেতর শ্রেণি-দূরত্বটা ঠিকই রয়ে গেছে। একে অপ্রত্যাশিত বলা যাবে। কেননা, এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তো এমনি এমনি ঘটেনি। ঘটেছে জনগণের অসামান্য কষ্ট ও আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে। '৪৬-এ লোকে ভোট দিয়েছে এবং দাঙ্গা ও দেশভাগের কারণে নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। '৭০ সালেও ভোট দিয়েছে। কিন্তু এবার দাঙ্গা সহ্য করা নয়; যেতে হয়েছে সশস্ত্র যুদ্ধে। তবে পরিণামটা যে একই- তার ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা সহজ। সেটা হলো রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জনগণের হয়নি এবং দেশে এমন কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি, যার ভেতর দিয়ে শাসক ও শাসিতের ভেতরকার শ্রেণি-দূরত্বটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
জনতার মধ্যে সমাজ বিপ্লবের সাহস কি ক্রমেই কমে যাচ্ছে? তার বদলে ভয় গ্রাস করছে? পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের যখন জন্ম হয়, সেই জন্মের পেছনে একটি অতিপ্রধান ভূমিকা ছিল ভয়ের। মুসলিম মধ্যবিত্ত ভয় পেয়েছিল অবিভক্ত ভারতে তাদের ভবিষ্যৎ নেই মনে করে। সেই ভয় তারা সংক্রমিত করে দিয়েছিল জনসাধারণের মধ্যে। প্রধানত ভয়ের কারণেই- ইংরেজের ভয়। তার চেয়ে বড় ভয় হিন্দুর। ভয়ের তাড়নাতেই মুসলমানদের প্রায় সব ভোটই গিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের বাক্সে। ফলে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সাম্প্রদায়িকতা এ দেশের পুরাতন ব্যাধি। ইংরেজ আমলে এই ব্যাধির প্রকোপে আমরা অনেক দুর্ভোগ ভোগ করেছি। পাশাপাশি থেকেও দুই সম্প্রদায় পরস্পর শত্রুতা করেছে; নিজেদের স্বার্থকে এক করে দেখতে পায়নি। ইংরেজ যুগে মুসলমান মধ্যবিত্ত সত্যি সত্যি পিছিয়ে পড়েছিল এবং হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে পিছিয়ে-পড়া মুসলমানের এমন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, যাতে পরস্পর মিলে শাসক ও শাসিতের শ্রেণি-দূরত্ব দূর করতে পারে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও শাসকদের বিরুদ্ধে জনতার ঐক্য প্রচেষ্টা যেন ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
শাসিতরা একদিন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল; এর সাহায্যে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে বলে। সেই অস্ত্র যখন বরং উল্টো কাজ করবে বলে ভয় হলো, তখন তারা একে পরিত্যাগ করে অন্য একটা অস্ত্রই শানিত করে তুলতে চাইল- বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্ত্র। স্বাধীনতা আন্দোলনে সেই অস্ত্রই মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করেছে, যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে। স্বাধীন বাংলাদেশেও যখন শাসিতদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ফিকে হয়ে যাচ্ছে, তখন কী করতে হবে?
আমাদের বর্তমান শাসক শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে কিছুতেই স্খলিত হবে না, যদি রাষ্ট্রের চরিত্রে অর্থাৎ তার অভ্যন্তরে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা না যায়। আর সেই পরিবর্তন তো ঘটবে না, যদি সমাজের কাঠামোতে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানো না যায়। ঘটিয়ে তেমন একটা সমাজ গড়ে তোলা না যায়, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা বৈরিতার হবে না; হবে মৈত্রীর। সমাজে বৈষম্য কমে গিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য। মুক্তির পথ সেটাই। ওই মুক্তির জন্যই আমাদের সংগ্রাম, যা এখনও সফল হয়নি। এর জন্যই আমাদের প্রতীক্ষা। প্রতীক্ষা একটি সামাজিক বিপ্লবের।
শুধু প্রতীক্ষায় তো কুলাবে না। দরকার হবে আন্দোলনের। মুক্তির আন্দোলনকে আরও বেগবান ও অগ্রসরমান করে তোলা চাই। চাই শ্রেণিচ্যুত মধ্যবিত্তের সঙ্গে মেহনতি মানুষের সংগ্রামী ঐক্য, যেমনটা দেখেছি এবং পেয়েছি আমরা বায়ান্নতে, ঊনসত্তরে এবং একাত্তরে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন