- মতামত
- আত্মঘাতী
আত্মঘাতী

গবাদি পশু উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হইবার পরও কোন প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী ভারত হইতে বৎসরে কয়েক সহস্র টন গরু ও মহিষের মাংস আমদানি করা হইতেছে উহা আমরা সত্যিই বুঝিতে পারিতেছি না। শুধু উহাই নহে, বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে উদ্ৃব্দত করিয়া শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হইয়াছে, বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটেল ও দূতাবাসের জন্য আমদানীকৃত উক্ত মাংস রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে বিক্রি হইতেছে; এই ধারা অব্যাহত থাকিলে অচিরেই যে উহা দেশের আনাচে-কানাচে গড়িয়া ওঠা গবাদি পশুর খামারিদের সমূহ সর্বনাশের কারণ হইবে তাহাও বলিবার অপেক্ষা রাখে না।
মনে রাখিতে হইবে- প্রতিবেদন অনুসারে- উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় গত বৎসর কয়েক লক্ষ খামারির- যাহাদের উল্লেখযোগ্য অংশ পর্যায়ভুক্ত- ২১ লক্ষাধিক পশু অবিক্রীত থাকিয়া যায়; উহার পূর্বের বৎসর যে সংখ্যাটি ছিল ২৮ লক্ষ। আর যেখানে দেশি গরুর মাংস খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি অন্তত ৬০০-৬৫০ টাকায় বিক্রয় করিতে হয়, সেখানে আমদানীকৃত মাংসের মূল্য পড়ে ৪০০-৫০০ টাকা।
আমাদের ইহাও মনে আছে, প্রতিবেশী দেশটির সরকারের কড়াকড়ির কারণে কয়েক বৎসর পূর্বে ভারত হইতে গরু আমদানি বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক লক্ষ খামার গড়িয়া ওঠে; বহু খামারি এই ব্যবসায় তাহাদের শেষ সম্বল পর্যন্ত বিনিয়োগ করিয়াছেন। ফলে ভোক্তাদের সস্তায় প্রোটিন সরবরাহ করিতে যাইয়া আমদানিকারকরা যে হিতে বিপরীত কাণ্ড ঘটাইবার আয়োজন করিতেছেন উহা বোঝা কষ্টকর কিছু নহে।
এদিকে, মাংস আমদানির জন্য সরকারি দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন তথা বিএসটিআই এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ তথা বিসিএসআইআরের সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক হইলেও প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হইয়াছে, কখনও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়- যেখানে আবার উপযুক্ত পরীক্ষাগার নাই, কখনও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় বা সিভাসুর পরীক্ষাগারের সনদ দিয়াই ঐ কার্যক্রম চলিতেছে। উপরন্তু, গত বৎসরের জুনে মাংস আমদানির জন্য পূর্বানুমতির বিধান চালু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় কাহাকেও মাংস আমদানির অনুমতি না দিলেও উহার আমদানি থামিয়া নাই; অর্থাৎ অবৈধভাবেই চলিতেছে লাল মাংস আমদানি এবং সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টির সম্মুখ দিয়াই এই অপকর্ম চলিলেও উহারা সম্ভবত শীতনিদ্রায় রহিয়াছে। আরও উদ্বেগজনক হইল, মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকাংশে মানহীন মাংস আমদানি হইতেছে; দেশের অভ্যন্তরেও উক্ত মাংস সংরক্ষণের ব্যবস্থা যেনতেন প্রকারের; কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং উক্ত মাংস সতেজ দেখাইবার প্রয়োজনে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিকও ব্যবহার করা হয়।
প্রতিবেদন মতে, গত বৎসরের অক্টোবর মাসে সাভারে অবস্থিত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতাধীন গবেষণাগারে রাজধানীর জুরাইন হইতে সংগৃহীত আমদানীকৃত দুই নমুনার মাংস পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে- প্রথম নমুনায় প্রতি গ্রামে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অ্যারোবিক প্লেট ছিল ৫৫ লক্ষ, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মাত্রা ১০ লক্ষ; আর দ্বিতীয় নমুনায় উক্ত ক্ষতিকর উপাদান ছিল ৬০ লক্ষ। দুইটা নমুনাতে ক্ষতিকর অ্যান্টেরোব্যাকটেরিয়াসিস ছিল যথাক্রমে ১৬০০ ও ৭০০০, যদিও গ্রহণযোগ্য মাত্রা হইল এক সহস্র।
আমরা জানি, আমদানীকৃত মাংস জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বিধায় গত বৎসরের বাজেটে সরকার উক্ত মাংসের উপর উচ্চহারে শুল্ক্ক বসাইবার পাশাপাশি উহা আমদানির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতির নিয়মও আরোপ করিয়াছে; এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব যেমনটা বলিয়াছেন- গত জুনের পর মাংস আমদানির নূতন কোনো অনুমতি তাহারা প্রদান করেন নাই। আমাদের প্রত্যাশা হইল, মানহীন ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এই সকল মাংস আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে। এই ক্ষেত্রে কোনো ফাঁকফোকর থাকিলে চলিবে না।
মন্তব্য করুন