- মতামত
- হযবরল
হযবরল

এই বৎসর হইতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হইলেও উহার বাস্তবায়ন লইয়া শুরুতেই যে সকল প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে, তাহা অনাকাঙ্ক্ষিত। ইতোমধ্যে সংশ্নিষ্ট শ্রেণির শিক্ষকরা অনলাইনে নামকাওয়াস্তে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হইলেও বাদ পড়িয়াছেন প্রধান শিক্ষকগণ।
রবিবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা নূতন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় ইহা বাস্তবায়নে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি বাধা হইয়া দাঁড়াইতেছেন। আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধান হিসাবে তাঁহাদের প্রশিক্ষণই সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
স্বীকার করিতে হইবে, নূতন শিক্ষাক্রম লইয়া ইতোমধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও আশাবাদ জাগ্রত হইয়াছে। বিশেষত দীর্ঘদিনের মুখস্থনির্ভর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া ও পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থার পরিবর্তে পারদর্শিতায় গুরুত্ব দিয়া শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা ইহার রূপরেখায় বলা হইয়াছে। শিশুদের আনন্দময় শিখন নিশ্চিত করিতে তৃতীয় শেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করা হইয়াছে। অন্যান্য শ্রেণিতে পরীক্ষা হইলেও সেইখানে বিকল্প মূল্যায়নে শিক্ষকের অনন্য ভূমিকা রহিয়াছে। শিক্ষকের পড়াইবার চিরাচরিত ভূমিকায় পরিবর্তন আসিবে, যথায় শিক্ষক সহযোগী হিসাবে সমন্বয়কারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইবেন। মূল্যায়নে নম্বরের পরিবর্তে মন্তব্য চালু হইবার কথা রহিয়াছে, যাহাতে শিক্ষার্থীদের আর জিম্মি হইবার সুযোগ না থাকে। এতদ্ব্যতীত শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষার বিষয়টি নূতন শিক্ষাক্রমে জোর দেওয়া হইয়াছে। তজ্জন্যই শিক্ষকের দক্ষতা আলোচ্য ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক নূতন শিক্ষাক্রমের বিষয়াবলি শুরুতেই আত্মস্থ করিবেন এবং ইহা শ্রেণিকক্ষে বাস্তবায়ন কৌশলও তাঁহাদের বুঝিতে হইবে।
শুধু সংশ্নিষ্ট শিক্ষকের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করিলেই চলিবে না; তৎসঙ্গে যথাযথ বাস্তবায়নে প্রধান শিক্ষকেরও নূতন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকিতে হইবে। প্রধান শিক্ষকের প্রশিক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকিবার কারণে কী ধরনের সংকট অন্যান্য শিক্ষক পোহাইতেছেন; সমকালের প্রতিবেদনে তাহার কয়েকটি বিষয় আসিয়াছে। নূতন শিক্ষাক্রমে শিখনের সহযোগী হিসাবে নানা ধরনের শিখন উপকরণের কথা বলা হইয়াছে। ঐ উপকরণ একজন শ্রেণিশিক্ষকের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নহে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঐগুলি সংগ্রহ করিতে হইলে প্রধান শিক্ষকই ভরসা। হাতেকলমে শিখাইবার জন্যও প্রধান শিক্ষকের ইতিবাচক মনোভাব জরুরি।
আলোচ্য প্রতিবেদনে যেমনটি আসিয়াছে, কৃষি বিষয়ের এক শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের মাঠে লইয়া গিয়াছেন; তখন প্রধান শিক্ষক ক্লাস না করিয়া কেন শিক্ষার্থীদের মাঠে লইয়া যাওয়া হইল- প্রশ্ন তুলিয়াছেন। গল্পের মাধ্যমে পড়াইবার নির্দেশনা রহিয়াছে। তথায় গল্পের মাধ্যমে পড়াইলে প্রধান শিক্ষক ভাবিতেছেন, শিক্ষকরা বুঝি পড়াশোনা বাদ দিয়া অন্য গল্প করিতেছেন।
নূতন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানের যথাযথ ধারণা থাকিলে বিরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হইত না। বলাবাহুল্য, শুধু ধারণা দিবার জন্যই নহে, বরং সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রম সুচারুরূপে বাস্তবায়নেও প্রতিষ্ঠানপ্রধানের প্রশিক্ষণ জরুরি। তিনি যেহেতু প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়া থাকেন, সেহেতু নূতন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে তাঁহার নেতৃত্বই অধিক যুক্তিযুক্ত এবং তৃণমূল পর্যায়ে বাস্তবায়নের পথ ইহা আরও সুগম করিবে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের শুরুতেই এই হযবরল অবস্থার কারণও সমকালের প্রতিবেদনে আসিয়াছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর-মাউশি যথাসময়ে প্রশিক্ষণ পরিচালক নিয়োগ দিতে পারে নাই। এখন প্রত্যাশা করা হইতেছে, নূতন পরিচালক কাজ শুরু করিলে এই মাসের মধ্যেই প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হইতে পারে। এই ক্ষেত্রে 'শুভস্য শীঘ্রম' বলিতে পারি আমরা। তৎসঙ্গে নূতন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়েও নজর দিতে হইবে বৈকি। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ রাজধানীতে অনেক প্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ নাই; কোথাও নাই বাগান বা উদ্যান। আবার শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষাদানের কথা বলা হইলেও প্রয়োজনীয় অনেক উপাদানই গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলিতে নাই।
আমরা প্রত্যাশা করি, ধাপে ধাপে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নকালে শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ সংশ্নিষ্ট সকল বিষয় নিশ্চিত করা হইবে। মনে রাখিতে হইবে, আধাআধি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নূতন শিক্ষাক্রমের সুফল পাওয়া যাইবে না।
মন্তব্য করুন