শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হলো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন কতজন শিক্ষক আছেন এবং সেই সংখ্যক শিক্ষকের তুলনায় কতজন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে তার একটি সরল অনুপাত। এই অনুপাত সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক কতটুকু কাজ করবেন এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি কতটুকু মনোযোগী হবেন সে সমন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যায়। সঠিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত কম হলে শিক্ষকরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন, তাদের সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করতে পারেন। এমনকি একজন শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি আলাদাভাবে নজর রাখতে পারেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দক্ষতা অনুসারে শিক্ষকরা আলাদা শিক্ষণ কৌশল তৈরি করতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষক- শিক্ষার্থী অনুপাত কম হলে তা শিক্ষার্থীদের সাফল্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বেশি হলে শিক্ষকদের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। বরং এ অনুপাত কম হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা শিক্ষার্থীর মাঝে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত একজন শিক্ষককে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার দিকে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। একজন শিক্ষকের পক্ষে কখনোই অনেক শিক্ষার্থীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিক্ষককে বাধ্য হয়ে শুধু সিলেবাস শেষ করার দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। এখন আমাদের জানতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত সাধারণত কত হওয়া উচিত? গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ :২০ কে আদর্শিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শেখার ক্ষমতাকে বিশ্নেষণ করে
একই ধরনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গ্রুপ করলে ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের একটি চিত্র তুলে ধরছি। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত নরওয়েতে যথাক্রমে ১ :১১ এবং ১ :১০, স্পেনে যথাক্রমে ১ :১৩ এবং ১ :১০, জাপানে যথাক্রমে ১ :১৬ এবং ১ :১২, ফ্রান্সে যথাক্রমে ১ :১৮ এবং ১ :১৩, যুক্তরাষ্ট্রে ১ :১৬, যুক্তরাজ্যে যথাক্রমে ১ :২১ এবং ১ :১৬। বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে ১ :৩৮, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ১ :৪, স্কুল ও কলেজগুলোকে একসঙ্গে করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১ :৩০, মাদ্রাসা শিক্ষা পর্যায়ে ১ :২৪, টেকনিক্যাল-ভোকেশনাল শিক্ষায় ১ :২১, প্রফেশনাল শিক্ষায় ১ :১১, টিচার এডুকেশন প্রোগ্রামে ১ :১২, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় ১ :৪০। সর্বোপরি শিক্ষাক্ষেত্রে ১ :৩২। বিশেষ করে প্রাইভেট কলেজ পর্যায়ে ১ :৩৭, পাবলিক কলেজ পর্যায়ে ১ :৫৩। একইভাবে স্কুল ও কলেজকে একসঙ্গে ধরা হলে প্রাইভেট পর্যায়ে ১ :২৯, পাবলিক পর্যায়ে ১ :৪১। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১ :২২, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১ :৫৮ দেখা যায় (সূত্র :বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০২১)।

উপরোক্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত সবচেয়ে কম। এই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পাচ্ছে এবং তাদের ভালো ফলের পেছনে এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। একইভাবে আমাদের পাবলিক সেক্টরের স্কুলগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত সবচেয়ে বেশি, যা শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা পেতে বাধার সৃষ্টি করছে বলে ধারণা করা হয়। শুধু তাই নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কেরও দিন দিন অবনতি হচ্ছে।
সবশেষে, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১ :৩০ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু এই অনুপাত প্রতি বছর বেড়েই যাচ্ছে। একটি কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে, যার মধ্যে মাত্র একটি হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত। আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হওয়া উচিত, এই অনুপাতকে ১ :২০ করতে গুরুত্ব দেওয়া। তাহলে আমরা স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব।

ড. গৌতম সাহা: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়