
বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে তেল জাতীয় ফসলের মধ্যে প্রধান ভূমিকা রাখে সরিষা, সেই সঙ্গে সূর্যমুখী আংশিক। স্বাধীনতাপূর্বে দেশে উৎপাদিত সরিষার তেলই ভোজ্যতেলের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করত। পরবর্তী সময়ে দেশে উফশী বোরো ধানের আবাদ বাড়তে থাকায় সরিষার আবাদ কমতে থাকে। সেই সঙ্গে সরিষার তেলে বিদ্যমান ইরুসিক এসিড নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করা হয়। এ সুযোগে সরিষার তেল বাদ দিয়ে মানুষ সয়াবিন তেলের দিকে বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়ে। সরিষার তেলে রয়েছে উচ্চমাত্রার স্মোক পয়েন্ট ২৪৯০ (যে তাপমাত্রায় তেল থেকে ধোঁয়া ওঠে), যা তেলের গুণাগুণ রক্ষা করে। বেশি তাপমাত্রায় রান্নার জন্য সরিষার তেল উপযোগী এবং রান্নায় এ তেল কম লাগে বিধায় তেল সাশ্রয় হয়।
দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রধান এ তেল ফসলটির আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। আশার কথা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তেল ফসলের ওপর যুগোপযোগী প্রকল্প নেওয়ার ফলে বর্তমানে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার তেল জনপ্রিয় হচ্ছে এবং এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৬ দশমিক ১০৬ হেক্টর জমিতে ৮ দশমিক ২৪৩ লাখ টন সরিষা উৎপাদিত হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের দেশে ২১ লাখ ৩৬ হাজার টন ভোজ্যতেল (পামঅয়েল ও সয়াবিন) আমদানি হয়। এতে ব্যয় হয় ১৮৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে আমাদের দেশে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে প্রাপ্ত ভোজ্যতেল উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র তিন লাখ টন। মূলত আমাদের দেশে রবি মৌসুমে তেল জাতীয় ফসলের চাষাবাদ হয়। খরিফ মৌসুমেও স্বল্প পরিমাণে উৎপাদন করা যায়। উচ্চফলনশীল জাত ও মানসম্মত বীজ ব্যবহার, উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, অনাবাদি পতিত জমি চাষের আওতায় এনে এবং ক্রপিং প্যাটার্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে তেল ফসলের আবাদি এলাকা বাড়িয়ে ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। উল্লিখিত বিষয়ে পরিকল্পনা আর বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণার্থে ২০২২-২৩ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থাৎ তিন বছর মেয়াদি ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে প্রায় ৪০ শতাংশ আমদানি ব্যয় হ্রাসের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
কর্মপরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় কয়েকটি বিষয় আমলে নেওয়া হয়েছে- ১. 'বোরো-পতিত-রোপা আমন প্যাটার্ন'-এর আওতায় প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমি রয়েছে। ওই প্যাটার্নে স্বল্প জীবনকালের আমন ব্রি-৭১, ব্রি-৭৫, বিনা-৭, বিনা-১৭, বিনা-২২ জাতের ধান চাষ করে সরিষার মৌসুমে স্বল্পমেয়াদি জাত বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭ অথবা বিনা সরিষা-৪, বিনা সরিষা-৯ দিয়ে চাষ করে পরবর্তী সময়ে বোরো চাষ করে আবাদি এলাকা বৃদ্ধিকরণ। ২. 'আউশ-রোপা আমন-পতিত' এবং 'পাট-রোপা আমন-পতিত' জমিতে বারি সরিষা-১৮ জাত অন্তর্ভুক্ত করে আবাদি এলাকা বৃদ্ধি। ৩. উপকূলীয় এলাকায় ৯ লাখ হেক্টর, বরেন্দ্র এলাকায় তিন লাখ, চর এলাকায় চার লাখ, হাওর এলাকায় ২ লাখ ৫০ হাজার ও পার্বত্য এলাকায় ১৬ লাখ হেক্টর জমি তেল জাতীয় ফসল চাষের আওতায় আনা। ৪. উফশী বীজ উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ। ৫. শস্যবিন্যাস বাস্তবায়নে ধান কাটা ও মাড়াই যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ধানের চারা রোপণের যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।
এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ তিন বছরে তেল আমদানির হার ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ হ্রাস করা যাবে। বাদাম ও সয়াবিনের তেল নিস্কাশন সম্ভব হলে সব তেল জাতীয় ফসল থেকে ৪৮ দশমিক ২৯ শতাংশ আমদানি ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হবে।
হমুহম্মদ আরশেদ আলী চৌধুরী :উপপ্রকল্প পরিচালক, তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
বিষয় : অন্যদৃষ্টি মুহম্মদ আরশেদ আলী চৌধুরী
মন্তব্য করুন