তিন ফসলি জমির অকৃষি ব্যবহার বন্ধে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অনুশাসন দিয়াছেন, উহাকে আমরা স্বাগত জানাই। মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে উদ্ৃব্দত করিয়া মঙ্গলবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হইয়াছে, মন্ত্রিসভার অনির্ধারিত আলোচনায় প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে কঠোরভাবে মানিয়া চলিতে হইবে এবং উহার বাস্তবায়ন তদারকি করিবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। উক্ত নির্দেশনা এমন এক সময়ে আসিল, যখন দেশে কৃষিজমির অকৃষি ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, তৎসহিত অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে বসতি নির্মাণ তো বটেই, সরকারি-বেসরকারি খাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ বহুবিধ অবকাঠামো নির্মাণের জন্যও কৃষিজমির বাছবিচারহীন ব্যবহার চলিতেছে। শুধু রাজধানী বা বড় শহরগুলির উপকণ্ঠই নহে; উপজেলা পর্যায়েও এই উদ্বেগজনক চিত্র দৃশ্যমান। ইহার ফলস্বরূপ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের কৃষি শুমারি-২০১৯ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, প্রতি বৎসর দেশে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাইতেছে শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ হারে। উক্ত শুমারিমতে, ২০০৮ সালে দেশে মোট আবাদি জমি ১ ক্রোড় ৯০ লক্ষ ৯৭ সহস্র হেক্টর থাকিলেও ২০১৯ সালে উহা হ্রাস পাইয়া দাঁড়ায় ১ ক্রোড় ৮৬ লক্ষ ৮১ সহস্র হেক্টরে। এহেন পরিস্থিতির সরাসরি আঘাত যে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় লাগিবে, উহা উপলব্ধির জন্য বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই। অতএব, সমস্যাটি নীতিনির্ধারণী মহলকে ভাবাইয়া তোলাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করিতেছি, উন্নতিশীল কৃষি গবেষণার সুফল হিসাবে উচ্চফলনশীল বীজ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে ধানসহ বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাইলেও প্রতি বৎসর খাদ্যপণ্য আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহার কারণে যখনই বিশ্ববাজারে কোনো কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, তখনই অভ্যন্তরীণ বাজারে দেখা দেয় অস্থিরতা। মোট কথা, কৃষিজমি বিদ্যমান হারে হ্রাস পাইতে থাকিলে ভবিষ্যতে একরপ্রতি ফসল উৎপাদন দুই গুণ বা তিন গুণ করিলেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হইবে না। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর উক্ত নির্দেশনা পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যকর হইবে বলিয়া আমাদিগের প্রত্যাশা।

তবে আমরা জানি, কৃষিজমি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এই প্রথম আসে নাই। গত এক দশকে বেশ কয়েকবার তিনি এই বিষয়ে সকলকে সতর্ক করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখজনক হইলেও সত্য, ঐ সকল নির্দেশনা অধিকাংশেই হয় অরণ্যে রোদন। আমরা মনে করি, একটা উপযুক্ত আইন থাকিলে বিষয়টার বাস্তবায়ন সহজ হইত। সেই ক্ষেত্রে যত্রতত্র কৃষিজমির অপব্যবহার বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বা সচেতন নাগরিকরাও আইনের আশ্রয় লইতে পারিতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, বারংবার উদ্যোগ গ্রহণের পরও অদ্যাবধি এহেন কোনো আইন প্রণীত হয় নাই। আমাদিগের মনে আছে, ২০১৫ সালে উচ্চ আদালতের এক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় 'কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন' শীর্ষক একটা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু জনমত যাচাইয়ের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আইনের খসড়াটি দেওয়া হইলেও অদ্যাবধি উহা আলোর মুখ দেখে নাই। উপরন্তু গত বৎসর একজন বেসরকারি সদস্য উপস্থাপিত কৃষিজমি (যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ) আইন-২০২২ সংসদে গৃহীত হওয়ার পর সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। উহাও কোনোদিন সংসদে পাস হইবে কিংবা আদৌ পাস হইবে কিনা, তাহা কেহ বলিতে পারে না।

আমাদিগের আশঙ্কা, কৃষিজমির অকৃষি ব্যবহারে বর্তমানে যে সকল আবাসন ব্যবসায়ী ও বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী নেতৃত্ব দিতেছেন, উক্ত আইন প্রণীত না হওয়ার পশ্চাতে তাঁহাদের কোনো প্রভাব থাকিতে পারে। এমনকি এতদ্‌বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত হইবার জন্য এই গোষ্ঠীর সহিত সংশ্নিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো অশুভ আঁতাত দায়ী হইতে পারে। আমাদিগের প্রত্যাশা, অবিলম্বে বিষয়টা অনুসন্ধানপূর্বক কৃষিজমি রক্ষায় একটা যথাযথ আইন প্রণয়নে কার্যকর উদ্যোগ গৃহীত হইবে। একই সঙ্গে এই দফায় তিন ফসলি জমি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী যে সময়োচিত কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করিয়াছেন, উহারও ধারাবাহিকতা রক্ষিত হইবে।