বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ হচ্ছে মুদ্রানীতি প্রণয়ন। কয়েক বছর ধরে বছরে একবার মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর আসার পর এই বছর থেকে পুনরায় দুইবার মুদ্রানীতি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য মুদ্রানীতি প্রকাশ করে। মুদ্রানীতির মূল কাজ হচ্ছে অর্থপ্রবাহ ও মুদ্রাস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
গত অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রক্ষেপণ করা হয় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ (বছর বছর)। গত বছর এই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এবারের মুদ্রানীতিতেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রক্ষেপণ করা হয় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কতখানি হবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার পুরোপুরি তুলে নেওয়া হলো। এ ছাড়া নতুন মুদ্রানীতিতে ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়ানোরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। বর্তমানে ব্যাংকের সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে। এখন সেখানে ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এর ফলে ব্যাংকগুলো এখন ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়াতে পারবে। তবে শিল্পঋণসহ অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অন্যান্য ঋণের বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন থাকবে। বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ কিছু স্কিম ছাড়া ঋণ আমানতের সুদহার ওঠানামা করতে দিলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বলে অনেক দিন ধরে অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন। নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আমানতের সুদহার উন্মুক্ত করে দেওয়া এবং ঋণ সুদহার কিছুটা শিথিল করায় তা আমানতের সুদহার বাড়াতে সহায়তা করবে এবং ইতোমধ্যে আমানতের সুদহার বাড়ার প্রবণতা শুরু হয়ে গেছে। এই মুদ্রানীতিতে ঋণে সুদহারের ৯ শতাংশ সীমা অপরিবর্তিত রেখে নীতি সুদহার বাড়াল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে পুনঃক্রয় চুক্তি বা রেপোর বিপরীতে ৬ শতাংশ সুদে ধার নিতে হবে, যা এতদিন ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। একইভাবে বিপরীত পুনঃক্রয় চুক্তি বা রিভার্স রেপোর সুদহার ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর ধারের সুদহার বাড়বে। এটি মুদ্রাস্ম্ফীতি কমাতে কতখানি কাজে লাগবে- সে প্রশ্ন রয়েই গেল। এবারের মুদ্রানীতির বিবৃতিতে টাকা পাচারের বিষয়টি সামনে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, দেশ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে। সাধারণত দু'ভাবে সম্পদ পাচার হয়- আন্ডার ইনভয়েসিং (পণ্যের দাম কম দেখিয়ে) এবং ওভার ইনভয়েসিং (পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে)-এর মাধ্যমে। এতে একদিকে দেশের টাকা বিদেশে চলে গেছে। অন্যদিকে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চার ভাগের এক ভাগ দামে এলসি খুলেছেন অনেক গ্রাহক। এই কাজটা করেছেন ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য। তবে বাকি তিন ভাগ অর্থ নিশ্চয় হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন। বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে।

মুদ্রাস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবারের মুদ্রানীতির অন্যতম লক্ষ্য। গত ডিসেম্বর শেষে মুদ্রাস্ম্ফীতি রয়ে গেছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে। মুদ্রাস্ম্ফীতি কমানোর হাতিয়ার হিসেবে নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়ালে কতখানি প্রভাব পড়বে, তাও দেখার বিষয়। কারণ ভোক্তাঋণ মোট ঋণের মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো।

সামগ্রিক বিবেচনায় এবারের মুদ্রানীতিকে সতর্কতামূলক বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ম্ফীতির প্রেক্ষাপটে এই মুদ্রানীতির সফলতা নির্ভর করছে- কত তাড়াতাড়ি এই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে আসে।

আনোয়ার ফারুক তালুকদার: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্নেষক