বন্য প্রাণ-প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটিয়েই ১০ হাজার বছর আগে কৃষিকাজের সূত্রপাত। পরবর্তী সময়ে চা, কফি, নীল, আখ, তামাক, ভুট্টার মতো ফসলের একতরফা বাণিজ্যিক চাষ দশাসই মহাবিলুপ্তি ঘটিয়েছে। শুধু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য নয়; সামাজিক বৈচিত্র্যও চুরমার করেছে এমন চুক্তিবদ্ধ বৃহৎ চাষের খামার ও বাগানগুলো। ব্রিটিশ উপনিবেশ নেই, পাকিস্তানি জুলুম নেই; কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে চা বাগানে এখনও ঔপনিবেশিক 'এস্টেট' শব্দটি চালু আছে। কর্তৃপক্ষ চাইলে এখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়, না চাইলে দেয় না। সেখানে যেন চলে ভিন্ন আইন।

সম্প্রতি হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত দেশের এক অনন্য সংবেদনশীল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেমা-কালেঙ্গার বহু বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ হাতিমারা চা বাগান কর্তৃপক্ষের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছে। বহু প্রাণী জখম হয়েছে। বহু প্রাণীর আশ্রয়, বিচরণ, আবাসস্থল এবং খাদ্য উৎস নিশ্চিহ্ন হয়েছে। গত ২৩ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যমে এসবের আলোকচিত্রও ছাপা হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ বিকেলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পক্ষে একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে চা বাগানে যায়। কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের অগ্নিদগ্ধ ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে দেয়নি। বাগানের সীমানা ফটকেই প্রতিনিধি দলের গাড়িটি আটকে দেওয়া হয়। প্রতিনিধি দল সেখানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়নি; বাধ্য হয়ে অগ্নিদগ্ধ ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করেই ফিরে আসে।

১৯৯৭ সালে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল দেশের এক অনন্য অরণ্য লাউয়াছড়া। তখন সবাই অগ্নিদগ্ধ এলাকায় যেতে পেরেছিল। বন বিভাগ কাউকে বাধা দেয়নি। ২০০৪ থেকে ২০১৭ সালের ২৬ মে পর্যন্ত দেখা যায়, সুন্দরবনের প্রায় ৬৫ একর বনাঞ্চল আগুনে পুড়েছে বা ঝলসে দেওয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমসহ পরিবেশকর্মীরা এসব জায়গা পরিদর্শন করতে পেরেছেন। বন বিভাগ বাধা দেয়নি। তাহলে হাতিমারা চা বাগান কর্তৃপক্ষ কেন পরিবেশকর্মীদের ঘটনাস্থলে যেতে দিচ্ছে না? বাগান কর্তৃপক্ষ কি এভাবে নিজেদের অন্যায় স্বীকার করে নিচ্ছে কিংবা অপরাধ গোপন করতে চাইছে? এ ক্ষেত্রে বন বিভাগ ও প্রশাসন কেন এখনও নিশ্চুপ- এটিও আরেক বিস্ময় হাজির করে।
পাকিস্তান টি অ্যাক্ট-১৯৫০ এর অধীনে তৎকালীন পাকিস্তান টি বোর্ড গঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ড গঠিত হয় এবং ২০১৬ সালে চা-আইন ২০১৬ জারি হয়। চা বোর্ডের কাজ হচ্ছে চা শিল্পের উন্নয়ন, এর ভেতর নতুন চা বাগান প্রতিষ্ঠা ও পরিত্যক্ত চা বাগান পুর্নবাসন। দেশে ১৬৭টি চা বাগানের ভেতর হবিগঞ্জে ২২টি টি এস্টেট ও ৩টি বাগান আছে। চা বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেশের সব চা বাগানের তালিকা আছে।

জানা যায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত হাতিমারা চা বাগানটি ধারাগাঁও টি এস্টেটের একটি ফাঁড়ি বাগান। বাহুবলে অবস্থিত মোট ৪৫৯৯ দশমিক ৬৩ একরের ধারাগাঁও বাগানটি চা বোর্ডে নিবন্ধনকৃত এবং এর নিবন্ধন নম্বর এ-টু।
সম্প্রিতিক অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ ছিল চা বাগান সম্প্রসারণ। চা গাছ লাগানোর জন্য নিজেদের ইজারা নেওয়া জায়গার প্রায় ১৪০টি প্রাচীন বৃক্ষ কেটে আগুন দেয় কর্তৃপক্ষ। বাগান কর্তৃপক্ষ আগুন লাগিয়ে শুধু বন্যপ্রাণী হত্যাই করেনি; প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গাছ কেটে এই ভূমির শ্রেণিও পরিবর্তন করেছে। টিলাভূমি কেটে সমান করেছে। বনতল, ঝোপ, লতাগুল্ম সব ধ্বংস করেছে। আমলকী, বহেরা, আউলা, আম, জাম, তেঁতুল, বট, কাঁঠালের মতো দেশি বৃক্ষ প্রজাতি কেটে ফেলেছে। চা বাগান সম্প্রসারণের নামে একটি বাস্তুতন্ত্র লন্ডভন্ড করে বহু বন্য প্রাণ হত্যার এ ঘটনা দেশের বিদ্যমান 'বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২'-এর চূড়ান্ত লঙ্ঘন। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, হাতিমারা চা বাগানটি ফিনলে কোম্পানির এবং বাগানে চা কারখানাও আছে। প্রায় ২৫০ বছর ধরে জেমস ফিনলে এ অঞ্চলে চা বাণিজ্য করছে। বিশাল এই স্কটিশ কোম্পানি কোনোভাবেই সাম্প্রতিক এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে কি?

খাগড়াছড়ির পাবলাখালীর পর দেশের বৃহত্তম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেমা-কালেঙ্গা। ১৯৮২ সালে একে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ৪৪৩৬ দশমিক ৭১ একর আয়তনের এই বনটি চরিত্রের দিক থেকে মিশ্র চিরহরিৎ। লজ্জাবতী বানর, উল্টোলেজি বানর, পাঁচ প্রজাতির কাঠবেড়ালী, চশমাপরা হনুমান, উল্লুক, বনরুই, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ, শজারু, গন্ধগোকুল, শূকর, সাপ ও নানা জাতের পাখির আবাসস্থল এই বন। বৃহৎ মালায়ান কাঠবিড়ালী শুধু এই বনেই বাস করে। এই বনে আছে বিরল সব ঔষধি লতাগুল্ম। মোট ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভরপুর এই বন। দেশের সর্ববৃহৎ শকুনের বিচরণস্থলও এই বন। এখানের ময়নাবিল এলাকায় প্রায় ৩৮টি শকুন পরিবারের বাস। এই বনের আশপাশে ত্রিপুরা, খাড়িয়া, ওঁরাও, মুন্ডা পরিবারও আছে। হাতিমারা চা বাগানটি রেমা-কালেঙ্গা বনের প্রতিবেশ অঞ্চলেই অবস্থিত। বন ও চা বাগানের আদিবাসী ও স্থানীয় মানুষ কয়েক দিন ধরে হাতিমারা চা বাগানের দেওয়া আগুনে মৃত বহু বন্যপ্রাণিদেহ মাটিচাপা দিয়েছে।

পঞ্চদশ কি ষোড়শ শতক পর্যন্ত চীন ছাড়া দুনিয়ার আর কোথাও চায়ের বাণিজ্যিক চল ছিল না। ১৬১০ সাল থেকে ওলন্দাজ বণিকেরা চীন থেকে চা বাণিজ্য শুরু করে। ১৮৯৪-৯৫ সালের চীন-জাপান যুদ্ধের ফলে ইউরোপের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের রূপ পাল্টালে ইউরোপ নিজেই চা চাষে মেতে ওঠে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া এবং ১৮৯৪ সালে চট্টগ্রামের কোদালায় চা উৎপাদন শুরু হয়।
মজুরি বিতর্ক থাকলেও চা শিল্প আজ বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ খাত। আর এই খাতের বিকাশে চা বাগান সম্প্রসারণ করতে হবে। কিন্তু এই বাগান সম্প্রসারণে বারবার প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটছে। স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতমুখর পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। হাতিমারা চা বাগানের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের এই বার্তা দেয় যে, প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব চা বাগান সম্প্র্রসারণ নীতিমালা জরুরি।

আশা করি, হাতিমারা চা বাগান কর্তৃপক্ষ পরিবেশকর্মীসহ সবাইকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে দেবে। গোপন করে, ধামাচাপা দিয়ে কোনো পরিবেশগত কিংবা সামাজিক অন্যায় আহাজারি দাবিয়ে রাখা যায় না।

পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
animistbangla@gmail.com