উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার বুধবার প্রকাশিত ফল অনুসারে এই বৎসর উত্তীর্ণের হার কিংবা সর্বোচ্চ জিপিএর সংখ্যা হ্রাস পাইলেও ইহাকে নেতিবাচক বলা যাইবে না। কিন্তু হতাশার বিষয় হইল, এইবারের ফল শহর ও গ্রামের মধ্যকার পার্থক্য আরও স্পষ্ট করিয়াছে। একদিকে শহরের নামিদামি প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জিপিএ ৫; অন্যদিকে গ্রামের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য শিক্ষার্থীর কৃতকার্যের পরিসংখ্যান বিপরীতমুখী দুটি চিত্র স্পষ্ট করিতেছে। শহর আর গ্রামের মধ্যে শিক্ষার মানে ব্যবধান থাকিতেই পারে। কিন্তু ইহা এতটা হওয়া আমাদের শিক্ষার দুর্বলতারই লক্ষণ। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ জিপিএ ৫ পাইবে; কোনো প্রতিষ্ঠানে শতভাগ অকৃতকার্য হইবে- পাবলিক পরীক্ষার ফলে এইরূপ বৈষম্য মানিয়া লওয়া যায় না।
উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার এইবারের ফল আমরা স্বাভাবিক ধরিয়া লইতে পারি। ইহার পূর্বের দুইটি পরীক্ষা করোনা মহামারির কবলে পড়িয়া একটিতে সকলেই উত্তীর্ণ হইয়াছে; অন্যটি হইয়াছে সংশ্নিষ্ট পাঠ্যক্রমের আলোকে। অন্যদিকে প্রায় সকল বিষয়ে পরীক্ষার মাধ্যমেই এইবারের ফল আসিয়াছে। সেই দিক হইতে ২০১৮ কিংবা ২০১৯ সালের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলের তুলনায় এইবার শিক্ষার্থীরা ভালো করিয়াছেন। লক্ষণীয়, প্রতিটি বোর্ডেই ফল বিচারে ছাত্রীরা বেশ অগ্রগামী। পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাঁহাদের অধিক মনোযোগই ইহার প্রমাণ।

এই বৎসর ১১টি বোর্ডে প্রায় ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হইলেও অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পৌনে দুই লক্ষ। আবার কোনো শিক্ষার্থীই কৃতকার্য হইতে পারেননি এইরূপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অর্ধশত। এত শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীর উত্তীর্ণ না হইবার বিষয়টি অস্বাভাবিক। যে শিক্ষার্থী ধাপে ধাপে উত্তীর্ণ হইয়া উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়াছেন; এক দশক অধ্যয়নের পরও এই পর্যায়ে আসিয়া কেন অকৃতকার্য হইবেন? এতদ্ব্যতীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবারই অকৃতকার্য হওয়া উদ্বিগ্ন হইবার জন্য যথেষ্ট। আমরা মনে করি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক তথা সকলের প্রচেষ্টা থাকিলে শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই করুণ হাল হইবার কথা নয়।

বিশেষ করিয়া অকৃতকার্য শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই যখন গ্রামাঞ্চলে, তখন ইহার দায় তথাকার শিক্ষক ও অভিভাবকদেরই শুধু নয়, বরং সংশ্নিষ্ট শিক্ষা প্রশাসনও বিষয়টি পরিহার করিতে পারে না। বস্তুত উচ্চ মাধ্যমিকেই শুধু নহে, বরং শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক পর্যায় হইতেই গ্রাম-শহর বৈষম্য স্পষ্ট দৃশ্যমান। এই বৈষম্যের কারণেই শহরেও নামিদামি ও অবহেলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফারাক তৈরি হইয়াছে। ইহার অন্যতম কারণ, গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে উত্তম শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই অভাব রহিয়াছে। উত্তম শিক্ষক গ্রামে যদ্রূপ থাকিতে চাহেন না, তদ্রূপ অভিভাবকগণও সন্তানদের শহরে পড়াইবার দিকে অধিক মনোযোগী হন। এই চক্র ভাঙিতে শিক্ষা প্রশাসনেরও দায়িত্ব রহিয়াছে। এই পরিবর্তন এক দিনে সম্ভব না হইলেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করিয়া বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করিলে অবস্থার উন্নতি হইতে বাধ্য। আর ইহা শুরু করিতে হইবে শিক্ষা প্রশাসন দ্বারা শতভাগ অকৃতকার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে জবাবদিহিতে আনয়নের মাধ্যমে।

উচ্চ মাধ্যমিকের পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন থাকে প্রায় প্রত্যেকেরই। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, উচ্চশিক্ষায় সেই অর্থে আসন সংকট না হইলেও মেডিকেল, প্রকৌশলসহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা সীমিত। তজ্জন্য সর্বোচ্চ ফল লাভের পরও তথায় অনেকেরই সুযোগ হইবে না। উচ্চশিক্ষায় তাই কাঙ্ক্ষিত আসন নিশ্চিত করিতে লড়াইটা আমরা তাহাদের মধ্যেই দেখিব। আমরা চাহি, যোগ্যতার বিচারে যে নিজেকে প্রমাণ করিতে পারে, তাহার জন্য উচ্চশিক্ষা অবারিত হউক। উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সকল শিক্ষার্থীকে আমরা সমকালের পক্ষ হইতে অভিনন্দন জানাই এবং তাঁহাদের সাফল্য কামনা করি।

বিষয় : সম্পাদকীয়

মন্তব্য করুন