- মতামত
- বেপরোয়া
বেপরোয়া

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ড থামিবার কোনো লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসিবার অব্যবহিত পর হইতে অদ্যাবধি কতবার ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠন ইতিবাচক কোনো কারণে সংবাদের শিরোনামে আসিয়াছে, উহা হাতে গোনা যাইবে; আর কতবার যে উহা নেতাকর্মীর অপকর্মের জন্য নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হইয়াছে, তাহার কোনো হিসাব নাই। সংগঠনটা পুনরায় সংবাদের শিরোনাম হইয়াছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হস্তে সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মারজান আক্তারসহ একাধিক সাংবাদিক হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনায়।
শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউটকে ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করিতেছিলেন ছাত্রলীগের এক দল নেতাকর্মী। পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসাবে মারজান উক্ত ঘটনা ভিডিও করিতে গেলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী তাঁহার উপর চড়াও হন এবং তাঁহার মোবাইল ফোন কাড়িয়া লইবার চেষ্টা করেন। উপরন্তু তাঁহাদের চাপের মুখে ধারণকৃত ভিডিও মুছিয়া না ফেলায় উক্ত নেতাকর্মী মারজানকে চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া উত্ত্যক্ত করিয়াছেন। ঐ সময়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী একই কারণে আরটিভির ফটোসাংবাদিককেও হেনস্তা করিয়াছেন।
এই ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসিবার পরপরই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ বিভিন্ন বিরুদ্ধমতের ছাত্র সংগঠনকে অনেক শিক্ষাঙ্গন হইতে জোরপূর্বক বিতাড়িত করিবার অভিযোগ ওঠে। তদুপরি এই সংগঠনের নেতাকর্মীকে দেখা গিয়াছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে কোনো প্রকার প্রতিবাদ-বিক্ষোভের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায়সংগত দাবিতে আন্দোলনরত চারুকলার শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর তাণ্ডব উহারই ধারাবাহিকতা বলিলে ভুল হইবে না। দুর্ভাগ্যজনক, উহাদের এহেন অপকর্ম লইয়া অদ্যাবধি এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে অসংখ্যবার লিখা হইয়াছে; কিন্তু সকলই অরণ্যে রোদন।
সম্ভবত উহারই ফলস্বরূপ সংগঠনের নেতাকর্মী তাঁহাদের অপকর্মের পরিধি ও প্রকার বৃদ্ধি করিতে আশকারা পাইয়াছেন। যাহার প্রতিফলন হিসাবে আমরা গত এক যুগের অধিক সময়ে বহুবার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর নাম টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, অপহরণ এমনকি ধর্ষণের মতো জঘন্য ফৌজদারি অপরাধের সহিত যুক্ত হইতে দেখিয়াছি। অনস্বীকার্য, এই সময়ে কোনো কোনো ঘটনায়- বিশেষত সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে আমরা সংশ্নিষ্ট অভিযুক্ত নেতা বা কর্মীকে সংগঠন হইতে বহিস্কার করিতে দেখিয়াছি। কিন্তু ইহাও স্বীকার করিতে হইবে, একবার আলোচনা থামিয়া যাওয়ার পর ঐ বহিস্কারাদেশ উঠিয়া গিয়াছে এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তি পুনরায় একই অপকর্মে লিপ্ত হইয়াছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও আমরা বহুবার ছাত্রলীগের আদর্শচ্যুত নেতাকর্মীর উদ্দেশে শক্ত সতর্কবার্তা জারি করিতে দেখিয়াছি। এহেন সতর্কবার্তা সত্ত্বেও যে উহাদের অপকর্ম চালাইতে কোনো অসুবিধা হয় না- বৃহস্পতিবারের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাই তাহার প্রমাণ।
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বেপরোয়া আচরণ শুধু সংগঠনের ঐতিহ্যেই কালিমা লাগাইতেছে না; সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও উহার গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে ঠেকিয়াছে। এমনকি ইহার কারণে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তিও যে ক্ষুণ্ণ হইতেছে- উহা এক প্রকার হলফ করিয়াই বলা যায়। অতএব, এখনই সময় সংগঠনের বেপরোয়া নেতাকর্মীকে নিয়ন্ত্রণে আনয়নের।
মনে রাখিতে হইবে, দেশের সংবিধান শিক্ষার্থীসহ সকল নাগরিককে শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করিবার অধিকার দিয়াছে। সুতরাং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর হামলা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। উপরন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো সংবাদকর্মীকে বাধাদানও সংবিধানের মতপ্রকাশের অধিকারসংবলিত বিধানের বিরুদ্ধাচরণ। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যাহা কোনো প্রকারেই কাম্য নহে। অতএব, আন্দোলনকারীদের উপর হামলা তো বটেই, কর্তব্যরত সমকালসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের সংবাদকর্মীকে হেনস্তার ঘটনাও উপেক্ষা করিবার সুযোগ নাই।
আমাদের প্রত্যাশা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও অবিলম্বে ঘটনাসমূহের সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।
মন্তব্য করুন