
সময়ের ব্যবধানে কোনো কোনো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। দুই যুগ আগে চিনির কেজি ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। এর দাম এখন তিন অঙ্কে চলে গেছে। একইভাবে দাম বেড়েছে অন্যান্য পণ্যেরও। দেড় যুগ আগের ১৪ টাকা লিটারের কেরোসিন ও ডিজেল এখন ১০৯ টাকা। মাঝখানে ১১৪ টাকাও হয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতে। দেড় যুগ আগে ঢাকা-ভোলা রুটে লঞ্চে ডেকের ভাড়া ছিল ৫০-৭০ টাকা। এখন ৫০০-৭০০ টাকা। ২০০৪-০৫ সালে ঢাকা মহানগরীতে লোকাল বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল ১ টাকা। মতিঝিল থেকে পল্টন পর্যন্ত এক টাকা ভাড়ায় যাতায়াতের অভিজ্ঞতা অনেকেরই রয়েছে। এখন সেই ভাড়া ১০ টাকা। ১৪ টাকার ডিজেল ১১৪ টাকা হয়েছে, তাই ১ টাকার ভাড়া ১০ টাকা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
গত দেড় যুগে মানুষের আয় কি ১০ গুণ হয়েছে? উচ্চবিত্তের আয় বাড়তে পারে। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আয় যে উল্লেখ করার মতো বাড়েনি, এতে সন্দেহ নেই। সেই সময় ঢাকা মহানগরীতে সর্বনিম্ন রিকশা ভাড়া ছিল ৬ টাকা। এখন ২০ টাকা। তার মানে রিকশাওয়ালার আয় বেড়েছে তিন গুণ। সে সময় যে রিকশাওয়ালা ঘরে বাতি জ্বালানোর জন্য ১৪ টাকায় এক লিটার কেরোসিন কিনতেন, তাঁকে সেই কেরোসিন কিনতে হচ্ছে ১০৯ টাকায়। অর্থাৎ আয় বেড়েছে তিন গুণ, ব্যয় বেড়েছে আট গুণ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব নেওয়া কর্তাব্যক্তিরা কেরোসিন দিয়ে হারিকেন, কুপি বা ল্যাম্প জ্বালানোর উদাহরণকে হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারেন! ভর্তুকি প্রত্যাহারের নামে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করলে ব্যয়ের খতিয়ান আরও লম্বা হবে।
শুধু দিনমজুর নয়; সাধারণ চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী এক কথায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আয় যা বেড়েছে; ব্যয়ের তুলনায় তা সামান্যই। সে সময়ের ২০ হাজার টাকা বেতনের চাকরিজীবী এখন হয়তো ৪০ হাজার টাকা বা আরও বেশি বেতনে চাকরি করছেন। কিন্তু সে সময় যে সংসারে মাসিক বাজার খরচ ছিল ৩ হাজার টাকা, এখন তা ১২ হাজারে ঠেকেছে। করোনা মহামারিতে চাকরি হারিয়ে, বেতন কমে অনেকের হাহাকার বেড়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ভালো নেই। তাই চাল ও আটা কেনার জন্য ভিড় বেড়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ওএমএসের ডিলারের দোকান বা ট্রাকের সামনে। একই অবস্থা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত টিসিবির ডিলারের দোকান বা ট্রাকের সামনে।
সমকালে ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সংবাদের প্রধান শিরোনাম- ভোরে 'ওএমএস যুদ্ধ' মোড়ে মোড়ে। এতে দেখা যায়, ৩০০ টাকা সাশ্রয়ের জন্য একজন ভোক্তাকে ৫-৬ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকেও দেখা গেছে লাইনে। কোনো কোনো ব্যক্তি চায়ের আড্ডায় ৩০০ টাকা ব্যয় করলেও এসব পরিবারের কাছে এ টাকা অনেক দামি। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে এ দেশে ৯-১০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি করার সংখ্যা একেবারে নগণ্য নয়। সেসব কর্মীর এক দিনের রোজগার ৩০০ টাকা। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই লোকলজ্জা বিসর্জন দিয়ে কিছু টাকা সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ওএমএস এবং টিসিবির ট্রাকের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা।
দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য না পেয়ে ফেরত যেতে হচ্ছে অনেককে। চাহিদার তুলনায় জোগান সীমিত হওয়ায় এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তাই সামাজিক সুরক্ষা খাতে আরও বরাদ্দ দেওয়া দরকার। অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ কাটছাঁট করে হলেও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়া হয়েছে। তাদের মাসে একবার দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি মসুর ডাল ও এক কেজি চিনি দেওয়া হচ্ছে। প্রতি পরিবারে পাঁচ সদস্য থাকলে বলা যায়, ৫ কোটি পরিবার উপকৃত হয়েছে। বাস্তবতা হলো দুই লিটার সয়াবিন তেল দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারে ১০ দিনের বেশি চলার কথা নয়। তাই মাসে অন্তত দু'বার টিসিবির পণ্য দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।
মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com
মন্তব্য করুন