
ভাষা নিয়ে একদিকে আমাদের গর্ব ও অহংকার, আবার সেই ভাষার প্রতি অবহেলা ও উদাসীনতা স্ববিরোধিতা বৈ কিছু নয়। রাষ্ট্রভাষার জন্য যাঁরা জীবন দিলেন; যাঁদের ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে 'মহান একুশে ফেব্রুয়ারি' পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনন্য মর্যাদা, তাঁদের প্রতিও আমরা যথাযথ শ্রদ্ধা-সম্মান জানাতে পারছি না।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা' এবং ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- 'রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।'
সংবিধানে বাংলা ভাষার উন্নয়নে পরিস্কার নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাকে পুরোপুরি দাপ্তরিক কাজকর্ম ও শিক্ষার মাধ্যম করা যায়নি। গণমাধ্যমের নানা পর্যায়েও বাংলা ভাষার পরিস্থিতি বলা চলে করুণ।
বাংলাদেশে ভাষা নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। একটি বাংলা একাডেমি, অন্যটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইউনস্টিটিউট। তাদের কর্মকাণ্ডে বাংলা ভাষার উন্নতি ও সমৃদ্ধি কতটা হচ্ছে, বোধগম্য নয়।
যে যার মতো ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহার করছে। সেখানে কোনো শাসন, শৃঙ্খলা নেই। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পর্যায়ে একটি ভাষানীতির কথা বলা হলেও সে বিষয়ে কোনো আলাপ, অগ্রগতি নেই। ভাষানীতির বিষয়টি মোটেই নতুন কিছু নয়। ভাষার ভিত্তিতেই এই জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। ভাষাসংগ্রামের রক্তবীজ থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। তাহলে ভাষার এই দুরবস্থা কেন?
ভাষা নিয়ে বিভিন্ন দেশে জরিপও হয়। ভাষার ব্যবহার, উন্নয়ন, সম্প্র্রসারণের ক্ষেত্রে এই জরিপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংশ্নিষ্টরা বিষয়টি জানেন না- তা নয়। তাহলে এ বিষয়ে তাদের কোনো উদ্যোগ-উৎসাহ নেই কেন? ভবিষ্যতে হবে কিনা- সে আভাস-ইঙ্গিতও নেই।
কোন দেশে এক বা একাধিক ভাষার প্রচলন থাকলে তাকে যথাথথভাবে পরিচালনার জন্য একটি সুচিন্তিত পরিকল্পিত ব্যবস্থার কাঠামো অনিবার্য। একভাষিক সমাজে, ভাষানীতি সাধারণত ভাষার একটি অনুমোদিত, প্রমিত ব্যাকরণ প্রচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক সমাজে, দুই বা ততোধিক ভাষার যোগাযোগ এবং/অথবা সংযোগের মাধ্যমে পরিস্থিতিগুলো পরিচালনা করা হয়। যাতে করে ভাষার আন্তঃব্যবহার ও উন্নয়ন সমন্বয় ঘটানো যায়।
দেশে একটি সময়োপযোগী, বৈজ্ঞানিক ভাষানীতি প্রণয়ন করা গেলে সমাজ-সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। সরকার-প্রশাসন, শিক্ষা, নাটক-সিনেমা-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সামাজিক জীবনকে ভাষা ব্যবহারের নীতিমালার অন্তর্গত করার বিকল্প নেই।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষার ব্যবহারে শৃঙ্খলা ও শাসন। কেননা, ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর প্রভাব দ্রুত বর্ধনশীল। এই মাধ্যমে ভাষার বিকৃতি মহামারি আকার ধারণ করছে। তাকে এখনই টেনে ধরা না গেলে বাংলা ভাষার মারাত্মক বিপদ ঘটবে।
ভাষার স্বাধীনতার নামে এখন এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। ভাষার রূপ দিয়ে চেনা যায় একটি জাতির সাংস্কৃতিক অগ্রগতি, তার স্তর ও মান। শুধু ভবন-সেতু দিয়ে উন্নতি পরিমাপ হয় না। যে কোনো জাতির উন্নত সংস্কৃতি ও জীবনবোধের অনিবার্য শর্ত হলো তার ভাষা। সুশৃঙ্খল কার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত-নিরাপদ যোগাযোগের শর্ত। ভাষার বিষয়টিও তাই।
ভাষা হচ্ছে মানুষের জীবন ও সমাজের গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের একটি মৌলিক দিক। তাকে অবজ্ঞা করে কোনো দেশ-জাতি অগ্রসর হতে পারেনি। বিশ্বে যেসব দেশ উন্নত, তারা তাদের মাতৃভাষাকে শিক্ষা-প্রশাসনসহ সর্বত্র সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়েছে। জাপান, জার্মানি, কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, চীনসহ উন্নত সব দেশেই ভাষানীতি আছে। তারা মাতৃভাষার মাধ্যমেই তাদের দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে গেছে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা ভাষা-স্বাধীনতা অর্জন করলেও আজ লড়তে হচ্ছে নিজেদের বিরুদ্ধে, যা খুব লজ্জা ও বেদনার।
কেন ভাষানীতি প্রয়োজন? ভাষানীতি প্রয়োজন এ কারণে, এ ক্ষেত্রে যে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে তা থেকে উত্তরণের পথ তৈরি করবে। এটা তাৎক্ষণিক হবে না। এ জন্য অনেক সময় লাগবে। যে বিষয়গুলো নীতিমালার অন্তর্গত হওয়া উচিত :
১. শিক্ষার বিভিন্ন ধারায় (প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা) ভাষার ব্যবহার ও মাধ্যম কেমন হবে, সে বিষয়ে পরিস্কার ও সুদূরপ্রসারী নীতিমালা দরকার। বাংলাদেশে শিক্ষার সাধারণ ধারায় বাংলা, ইংরেজি, আরবি ৩টি; কওমি মাদ্রাসায় আরবি, ফারসি, বাংলা, ইংরেজি ৪টি এবং ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়। বর্তমানে অঙ্ককেও একটি ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২. সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরিক কাজকর্মে আজও পুরোপুরি বাংলা চালু হয়নি। সব অফিস-আদালতে বাধ্যতামূলক ভাষার ব্যবহার সম্পর্কিত নীতিমালা জরুরি।
৩. গণমাধ্যম, সিনেমা-নাটক তথা মিডিয়া ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এমনকি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ভাষার ব্যবহার ঠিক করা দরকার।
৪. সামাজিক মাধ্যমে ভাষার বিকৃতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমকে গুরুত্বহীন বলা যাচ্ছে না। কারণ তা সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ও সংক্রমিত করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ব্যবহার ও প্রয়োগ সুনির্দিষ্ট করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
৫. আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা আছে। সে ভাষার ব্যবহার সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং তাদের ভাষার সঙ্গে বাংলার সংযোগ-ব্যবহার কী হবে সে বিষয়ে ভাবনা দরকার।
৬. ভাষার অর্থনৈতিক, সামাজিক শ্রেণিগত অবস্থানেও বৈষম্য বিদ্যমান। এর রাজনৈতিক ব্যবহার পরিহার করে একেও নীতিমালার অন্তর্গত করা সময়ের দাবি।
৭. বিদেশি ভাষার ব্যবহার ও তার প্রয়োগ, বাংলার বানান রীতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং গ্রহণযোগ্য প্রমিত ধারা চালু করার নীতি অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
আমাদের ভাষা আন্দোলন জাতিসংঘ-ইউনেস্কোর মাধ্যমে বিশ্বস্বীকৃত। ভাষাশহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হয়েছে। আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণার দাবি করছি। কিন্তু নিজ দেশে সেই কাজটি করতে পারিনি। তাহলে কেন আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি করছি? আর সেটা হলে এই ভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা ও চাহিদা বাড়বে। তার জন্য কি আমরা প্রস্তুত? আমরা কি বাংলা ভাষায় দক্ষ সেই সংখ্যক লোকবল তৈরি করতে পেরেছি?
'মাতৃভাষা' শব্দটিকে যেভাবে জনপ্রিয় করা হয়েছে সেভাবে 'রাষ্ট্রভাষা' শব্দকে জনপ্রিয় করা হয়নি। সেটা কোনো নিরীহ ভুল নয়। ভাষার রাজনীতি-অর্থনীতি এক জটিল সমীকরণ। যে কারণে ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরে একটি ভাষানীতির জন্য কথা বলতে হচ্ছে। অথচ এ কাজটি করা মোটেই জটিল-কঠিন কোনো কাজ নয়। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক
মন্তব্য করুন