ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এবার 'স্মার্ট বাংলাদেশ' করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই ধারাবাহিকতায় গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানবীর হাসান সৈকত স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে 'স্মার্ট ক্যাম্পাস' গড়তে নেতাকর্মীকে ১০ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সাংগঠনিক কর্মসূচি ও নির্দেশনার বাইরে ব্যক্তিগত ও দলবদ্ধভাবে যে কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলগুলোতে শতভাগ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডলে ক্রিয়াশীল অপরাপর প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রভৃতির সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক ও সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে; সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে সর্বাবস্থায় সহযোগিতা করতে হবে।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ বরাবরই দেশের সব ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলার সঙ্গে সংগঠন পরিচালনার নীতিতে বিশ্বাসী বলে দাবি করে থাকেন; যদিও বাস্তবতা তা বলে না। তারপরও ঢাবি ছাত্রলীগ পুরোনো নীতিবাক্য দফাওয়ারি জারি করে নেতাকর্মীকে সজাগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব নির্দেশনার বাস্তবায়ন কতটুকু হবে? কারণ ঢাবি এলাকায় চলতি মাসে দুটি চাঁদাবাজির ঘটনায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা নেতাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। দুই ঘটনায় পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রলীগ। বইমেলায় চাঁদা আদায় করতে গিয়ে কারাগারে রয়েছেন ছাত্রলীগের দুই নেতা। নীতি-নৈতিকতাবোধ কতটা কলুষিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গাড়ি ছিনতাই করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হতে পারেন! ব্যক্তির অপরাধে সংগঠনের বদনাম হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার পাশাপাশি ওই সন্তানের জন্য পরিবারও বিব্রত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় অস্ত্রের মহড়া চলত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রনেতাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় তা বন্ধ হয়েছিল। সে সময় ডাকসু সচল না থাকলেও ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সব ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি সমন্বয়ে পরিবেশ পরিষদ নামে একটা ফোরাম সক্রিয় ছিল। কিন্তু এখন সেই পরিবেশ পরিষদ নেই; ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থানও নেই। ঢাবি ক্যাম্পাসে এখন দেশি-বিদেশি অস্ত্রের মহড়া দেখা না গেলেও মাঝেমধ্যে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটার মহড়া দেখা যায়। ঢাবি ছাত্রলীগের ১০ দফার মধ্যে অপরাপর ক্রিয়াশীল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। আমরাও চাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছাত্র সংগঠনগুলো ঢাবিসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎপর থাকুক। তাদের সেই সহাবস্থান নিশ্চিতে প্রধান ভূমিকা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকেই নিতে হবে।

গত কয়েক মাসে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে, বারবার নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়েছে ছাত্রলীগ। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মারধরের সঙ্গে জড়িয়ে অপরাধকর্মের কারণে সংগঠনের কতিপয় নেতার ব্যাপারে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একইভাবে সিট বাণিজ্য, ক্যান্টিন বাণিজ্য ও যৌন হয়রানির সঙ্গে জড়ানোর কারণেই তাদের নিয়ে সংবাদ হয়েছে। ছাত্রলীগের এসব নেতাকর্মীকে 'দুর্বৃত্ত' বলে আখ্যায়িত করেছেন সংগঠনটির একসময়ের শীর্ষ নেতা, বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে নিজেরা বিব্রত বলে সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান।

হাইকোর্টে কোনো মামলা ও রিট শুনতে বিচারপতি বিব্রত হলে নিয়ম অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি অন্য বেঞ্চে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য পাঠান। ছাত্রলীগের ব্যাপারে সাদ্দাম-ইনান বিব্রত হলেও নিষ্পত্তির দায়িত্ব তাঁদেরই নিতে হবে। দুর্বৃত্তদের সংগঠন থেকে বের করে দিয়ে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে স্মার্ট ক্যাম্পাস নিশ্চিতের দায়িত্ব তাঁদেরই। আগের কমিটির এক নেতা অভিযোগ করেছিলেন, পান থেকে চুন খসলেই সংবাদ শিরোনাম হয় ছাত্রলীগ। সম্প্রতি বর্তমান সভাপতিও নারায়ণগঞ্জে অভিমানের ভাষায় বলেছেন, 'ছাত্রলীগ একটি খারাপ কাজ করলে একশো নিউজ হয়।' তবে সংবাদ বেশি হওয়ার অভিযোগ করলেও কাজটি যে 'খারাপ'- তা সভাপতি স্বীকার করে নিয়েছেন। ছাত্রলীগ অনেক বড় সংগঠন। এখানে দুর্বৃত্ত থাকতেই পারে। যত বেশি সংবাদ হবে; দুর্বৃত্ত চিহ্নিত করতে নীতিনির্ধারকদের তত সুবিধা হওয়ার কথা। কত সংবাদ হয়, তার চেয়ে জরুরি দুর্বৃত্তমুক্ত সংগঠন গড়ে তোলা। শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুই গ্রুপ সংঘর্ষে জড়ালে সংবাদ হওয়াটা কি অপ্রত্যাশিত? একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায় কে নেবে? একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনের পর দিন সংঘাত চললেও সমাধান কেন হচ্ছে না?

স্মার্ট ক্যাম্পাস গড়তে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে যে নির্দেশনা দিয়েছে, তার বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় রইলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি চর্চার মডেল হয়ে উঠুক। তাদের দেখে অন্যরা শিখবে। আর যেন কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সিট বাণিজ্য, যৌন হয়রানি, আদব-কায়দা শেখানোর নামে কোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ না ওঠে। ভাষার মাসে প্রত্যাশা থাকবে- ১৯৪৮ সাল থেকে যেভাবে সমগ্র বাঙালি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়েছিল; ১৯৫২ সালে যার চূড়ান্ত বিস্ম্ফোরণ ঘটেছিল এবং যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেভাবেই সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন গণতন্ত্রের পক্ষে থেকে দেশ ও মানুষের স্বার্থে রাজনীতি করবে; যেমনটি নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও দেখা গিয়েছিল।

মিজান শাজাহান:সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com