গত বৃহস্পতিবার দেশের মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনে নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে গ্রাহকদের। দুপুর ১২টার কিছু পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা নেটওয়ার্ক পাননি অন্তত দুই ঘণ্টা। গ্রামীণফোন দাবি করেছে, সিরাজগঞ্জের দুটি এবং টাঙ্গাইলের একটি জায়গায় সড়কের উন্নয়নকাজের সময় বুলডোজারে গ্রামীণফোনের ফাইবার অপটিক কেবল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন প্রায় আট কোটি গ্রাহক।

গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক অচল হওয়ায় নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়েছে মানুষকে। কথা বলার পাশাপাশি ইন্টারনেট সেবাও পাওয়া যাচ্ছিল না এই সময়ে। জরুরি যোগাযোগ করতে না পেরে এ সময়ে ভোগান্তিতে পড়েন গ্রাহকরা। কিন্তু এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের কাছে মোবাইল অপারেটরদের তদারকি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ব্যাখ্যা চাইলেও অপারেটরটিকে কোনো সদুত্তর দিতে আমরা দেখিনি।

দেশের সবচেয়ে বড় ও বিস্তৃত মোবাইল ফোন অপারেটরটির এই বিপর্যয় বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, গ্রাহকের ভোগান্তি। দ্বিতীয়ত, মোবাইল অপারেটরটির এই বিপুল পরিমাণ গ্রাহকের সেবা নিশ্চিত করার সক্ষমতা। পুরো নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা বিপর্যয়ের পর গ্রামীণফোন যে যুক্তি দিয়েছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত- এটাও যাচাইযোগ্য। বিশেষ করে টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জে ফাইবার অপটিক কেবল বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলা হলেও সারাদেশে নেটওয়ার্ক বিপর্যয় হলো কোন কারণে, এর কোনো উত্তর মেলেনি। আবার গ্রামীণের ফাইবার যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট অথবা ফাইবার অ্যাট হোমের হয়ে থাকে, তাহলে অন্য অপারেটর যেমন রবি বা বাংলালিংকেরও একইভাবে নেটওয়ার্ক সমস্যায় পড়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছে গ্রাহকরা প্রায় জিম্মি- এমন অভিযোগ অনেকেই করে থাকেন। পূর্ব ঘোষণা ছাড়া কলরেট বৃদ্ধি, কলড্রপ, দুর্বল নেটওয়ার্কসহ নানা ভোগান্তি রয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে গ্রামীণফোন নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। প্রতিটি ঘটনার পর এর যথাযথ কারণ খুঁজে বের করলে ও ব্যবস্থা নিলে শুধু গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করা নয়; বৃহস্পতিবারের ঘটনাও হয়তো এড়ানো যেত বলে অনেকে মনে করেন।

এমন ঘটনা আরও একটি বিষয় সামনে নিয়ে আসে। সেটি হলো, মোবাইল সেবার সরকারি অপারেটর টেলিটক। ২০০৫ সালে টেলিটক যখন দেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেছিল, তখন মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল না। কারণ সরকারি এই মোবাইল ফোন অপারেটর কম খরচে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার প্রত্যাশা জাগিয়েছিল। তাই মানুষকে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টেলিটকের সিমকার্ড কিনতে দেখা গেছে। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি যদি সেবার মান না বাড়ায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানকে কে নিয়ন্ত্রণ করবে? বিটিআরসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট মাসে মোবাইল ফোন গ্রাহক ছিলেন ১৮ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার (১৮৩.৫৮ মিলিয়ন)।

এখন মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো যদি তাদের সক্ষমতার তুলনায় গ্রাহক বৃদ্ধির দিকে বেশি নজর দিতে থাকে, ভবিষ্যতে এমন ভোগান্তির আশঙ্কা আরও তৈরি হবে- এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। গত বৃহস্পতিবারের ভোগান্তিতে এই সময় রিচার্জ কার্ড, ফ্লেক্সিলোডসহ কোনো ধরনের টাকা পাঠানো ও উত্তোলন করা যায়নি। ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আবার সেবা পরিচালনায় সমস্যা হয়েছে গ্রামীণফোনের ইন্টারনেট পরিষেবা দিয়ে পরিচালিত এটিএম বুথগুলোতেও। একইভাবে লেনদেনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের মধ্যেও মোবাইল ফোনে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়েছে বলে খবরে জানা গেছে।

ভবিষ্যতে মোবাইল ফোন সেবা নিশ্চিত করতে এসব অপারেটর কোম্পানিকে জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিটকের সেবার মান উন্নয়নে কাজ করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান যদি গ্রাহকসেবায় পিছিয়ে থাকে, তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সেবা ও জবাবদিহি আশা করা কতটা যৌক্তিক- এমন প্রশ্ন উঠবে।

এহ্‌সান মাহমুদ: সহ-সম্পাদক, সমকাল