
শহর-গ্রাম সর্বত্র যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠছে। যৌথ পরিবারে দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফু-ফুপাদের কাছ থেকে শিশুরা আদব-কায়দা শিখত। আর একক পরিবারে শিশুর খেলার সঙ্গী দাদা-দাদির পরিবর্তে মোবাইল ফোনের গেমস। এটি তুলনামূলক বড় শিশুদের বেলায় প্রযোজ্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চাকরিজীবী ও উদ্যোক্তা দম্পতির অফিসকালীন তাঁদের দুধের সন্তানের আশ্রয়স্থল হয় গৃহপরিচারিকার কোল। একক পরিবারে বাবা-মা উভয়ে কর্মস্থলে চলে গেলে এর বিকল্পও থাকে না।
মায়ের কর্মস্থলে ডে কেয়ার সেন্টার না থাকলে বাসায় আয়া বা গৃহপরিচারিকার কাছে শিশুসন্তানকে রেখে দুশ্চিন্তায় সময় কাটে এসব দম্পতির। গৃহপরিচারিকার দ্বারা শিশু নির্যাতনের চিত্র বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপরও বিকল্প না থাকায় ঝুঁকি নিচ্ছেন অনেক দম্পতি। একজনের আয় দিয়ে অনেক পরিবারে সংসার চালানো দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে দুজনকেই রোজগারে নামতে হয়। দেশে কর্মস্থলে ডে কেয়ার সেন্টার রাখার ধারণা নানা কারণে এখনও জনপ্রিয় নয়। আবার থাকলেও অনেক শিশুর ভিড়ে নিজের সন্তানকে জায়গা করে দিতে পারেন না সব চাকরিজীবী দম্পতি। তখন স্বল্প খরচে শিশুসন্তান দেখভালের জন্য লোক নিয়োগ দেন তাঁরা।
প্রসঙ্গটি ওঠল শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে আজিজুল ইসলাম ও রুলিয়া বেগম দম্পতির কথা বলা হয়েছে; গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় দুজনেই চাকরি করার কারণে যারা ১৭ মাস বয়সী ছেলে রুহানের যত্ন নিতে পারছিলেন না। তাই মাসিক ৩ হাজার টাকা বেতনে শরিফুল আলম লিটনকে সন্তান দেখভালের দায়িত্ব দেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তির কাছে শিশুকে বিক্রি করে দেন লিটন। মা-বাবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে উদ্ধার করেছে গাজীপুর সদর থানা পুলিশ। সেই সঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৩০ হাজার টাকায় শিশুকে বিক্রি করে দেওয়া লিটনের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হওয়ায় বেশ কয়েক দিন সন্তানের খোঁজ নেননি আজিজ-রুলিয়া। তাঁরা ভেবেছিলেন লিটন তাঁদের সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন। প্রতিবেদনে প্রকাশিত এ তথ্যে বাবা-মা হিসেবে তাঁদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জীবিকার তাগিদে গাজীপুরে আসা দরিদ্র এ দম্পতির জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা আমাদের সমাজের জন্য একটি শিক্ষণীয় বার্তা।
যৌথ পরিবারের 'ঝামেলা' থেকে বের হয়ে আসা ব্যক্তি কতটা অসহায় ও অনিরাপদ, তা আজিজ-রুলিয়ার শিশুসন্তান হারানো ও উদ্ধারের ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়। সচ্ছল পরিবারে যাঁরা শিশুসন্তানকে আয়া বা গৃহপরিচারিকার কাছে রেখে কর্মস্থলে যান, তাঁদেরও দুশ্চিন্তার কথা আমরা জানি। বিশ্বস্ত আয়া ভেবে মানসিক সান্ত্বনা আসতে পারে, দুশ্চিন্তা কাটে না। তবে দরিদ্র মানুষ না-হয় শহরজীবনে মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যৌথ পরিবার পরিচালনা করতে পারে না; সচ্ছল দম্পতি কেন বাবা-মাকে সঙ্গে রাখে না? স্বাধীন জীবনযাপনের অজুহাতে আমরা চিরায়ত সম্পর্ককে এড়িয়ে যাচ্ছি।
কর্মব্যস্ত দম্পতির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ূয়া সন্তানরা কম সময়ই বাবা-মাকে কাছে পায়। ফলে তারা বেড়ে ওঠে গৃহপরিচারিকা, শিক্ষক, কম্পিউটার বা মোবাইল গেমসের সঙ্গে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তারা হয়তো উৎরে যায়; কিন্তু বাস্তব জীবনের অনেক বিষয় থেকে যায় অজানা। যে শিশু দাদির কাছে গল্প শোনেনি, দাদার হাত ধরে নদী-বাগানের কাছে যায়নি, তার অন্তর্নিহিত চিন্তাশক্তি জাগ্রত হতে পারে না। কোনো মানুষ শৈশবকাল থেকে নিজের মতো করে চিন্তা করতে না শিখলে অন্যের চাপিয়ে দেওয়া মতবাদে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। গুলশানে হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলায় যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তখন এ মন্তব্যের বাস্তবতা অনুধাবন করা যায়।
পরিবার হচ্ছে আদর্শ বিদ্যালয়। ভালো পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তান কমই বিপথগামী হয়। মা-বাবার অনুপস্থিতিতে সন্তান দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা চাচা-চাচির কাছে যতটা নিরাপদ থাকবে, সেই নিরাপত্তা কখনোই অর্থের বিনিময়ে নিয়োগকৃত ব্যক্তির কাছে প্রত্যাশা করা যায় না।
মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com
মন্তব্য করুন