
প্রাকৃতিক চরিত্রের দিক থেকে যদিও নদী; মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রবাহিত ধলেশ্বরীর শাখাটির নাম 'কালিদাস সাওর'। সাওর মানে সাগর। হতে পারে, বর্ষাকালে ওই নদী ও সংলগ্ন বিল অঞ্চল একাকার হয়ে যেত বলেই এমন নাম। কিন্তু এখন সাগরতুল্য তো নয়ই; নদী হিসেবেও টেকে না। সমকালে সচিত্র সংবাদ প্রকাশ হয়েছে- দখলে ও দূষণে বিপর্যস্ত কালিদাস এখন সরু নালা মাত্র। (২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)।
এর আগের সপ্তাহে সমকালেরই প্রথম পৃষ্ঠায় বুড়িগঙ্গা-তুরাগ মোহনার আলোকচিত্র প্রকাশ হয়েছিল। দেখে নদীর প্রবাহ হিসেবে বিশ্বাস করা কঠিন। কালো থিকথিকে পানির মধ্যেই একজন জেলে যদিও জাল পেতেছেন, মাছ মিলছে না।
কেবল নাগরিক নদী নয়; দেশের কোথাও নদীগুলো ভালো নেই। শুধু নদী নয়; হাওর-বাওর, বিল-ঝিল, খাল-নালা, পুকুর-দীঘি- কিছুই ভালো নেই। তাত্ত্বিকভাবে এসবের নামই 'জলাভূমি'। ফকির লালন শাহের ভাষায়- 'গঙ্গায় গেলে গঙ্গাজল হয়/গর্তে তারে কূপজল কয়/ভেদ বিচারে'। লক্ষণীয়, রামসার কনভেনশনসহ (১৯৭১) প্রায় সব দলিলেই নদী থেকে পুকুর- সবই জলাভূমির অংশ। আমাদের পানি আইনেও (২০১৩) স্পষ্টভাবে একই কথা বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা অনেক বছর পর্যন্ত অনুধাবন করতে পারিনি- এ দেশের নদীগুলো যেমন জলাভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ, তেমনই জলাভূমিগুলো নদীরই পরিপূরক মাত্র।
আমরা ভেবেছি, নাম যেহেতু আলাদা; নদী, বিল কিংবা হাওর সম্ভবত স্বতন্ত্র 'ইউনিট'। যে কারণে আমরা নদীর তীর ধরে বেড়িবাঁধ দিয়েছি; নদীকে তার প্রতিবেশ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। অথচ বঙ্গীয় ব-দ্বীপে জলাভূমি ছাড়া নদীগুলো বাঁচবে না। কারণ বিল-ঝিল হচ্ছে নদীর ব্যাংকের মতো। বর্ষাকালে যেমন বাড়তি পানি জমা রাখা যায়, তেমনই শুকনো মৌসুমে সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি আনতে হয়। কিছু মাছ আছে, যেগুলো বিলে জন্মায় কিন্তু ডিম পাড়ে নদীতে। আবার কিছু মাছ আছে, যেগুলো নদীতে জন্মায় কিন্তু ডিম পাড়ে বিলে। যেমন ইলিশ মূূলত সাগরের মাছ; শুধু প্রজননের প্রয়োজনে নদীতে আসে। নদীকে বাঁধ দিয়ে ঘিরে ফেলে আমরা প্রতিবেশ ব্যবস্থার সঙ্গে এর সম্পর্কছেদ ঘটিয়ে ফেলেছি।
বিল-ঝিলগুলোর পরিস্থিতি আরও খারাপ। এ দেশের কৃষি ব্যবস্থা যদিও আক্ষরিক অর্থেই জলাভূমি থেকে উঠে এসেছে; আমরা 'একফসলি' বিল-ঝিলগুলো নদীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে পানি শুকিয়ে 'তিন ফসলি' জমি বানিয়েছি। ফলে একদিকে পানিপ্রবাহ, অন্যদিকে মৎস্যসম্পদে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে নদী-নালা ও বিল হয়ে ঐতিহাসিকভাবে দেশের আনাচে-কানাচে যে নৌপথগুলো ছিল, সেগুলোও বিলুপ্ত হয়েছে।
বঙ্গীয় ব-দ্বীপে জলাভূমির বাড়তি গুরুত্ব হচ্ছে ভূমি গঠনে। নদী ও জলাভূমির মিথস্ট্ক্রিয়া থেকেই আমাদের ভূখণ্ড ক্রমাগত দক্ষিণে সম্প্রসারিত হয়েছে। বিষয়টি বিস্মিত করেছিল ব্রিটিশ গবেষক উইলিয়াম উইলসন হান্টারকে। ১৮৭৬ সালে তিনি লিখছেন- 'এই দেশে ভূমি ও জলাভূমির মধ্যে নিরন্তর মিথস্ট্ক্রিয়া চলতে থাকে এবং এর মধ্য দিয়ে ভূমি গঠনের রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে। (আ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল)।
বঙ্গীয় ব-দ্বীপে জলাভূমিগুলোর পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে শাসন ব্যবস্থার প্রশ্নটি কীভাবে জড়িত, দেখিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দেবযানি ভট্টাচার্য- আঠারো শতক থেকেই ঔপনিবেশিক আইন, আমলাতন্ত্র ও প্রযুক্তি বঙ্গীয় ভূমি গঠন প্রক্রিয়া গ্রাস করে মুছে ফেলছিল এবং তখন থেকেই বঙ্গীয় ব-দ্বীপের 'আনমেকিং' শুরু হয়। (এম্পায়ার অ্যান্ড ইকোলজি ইন দ্য বেঙ্গল ডেল্টা)। বলা বাহুল্য নয়, বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ক্ষয় মানে জলাভূমিরই ক্ষয়।
বাংলাদেশে জলাভূমির পরিস্থিতি কতটা অবনতিশীল, তা বোঝা যায় এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স-ইপিআই দেখলে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এই সূচকে দেখা যাচ্ছে, জলাভূমি হারানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে করুণ। বৈশ্বিক তালিকার ৭৭তম অবস্থানে ভারত, ৮১তম অবস্থানে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অবস্থান ১০২তম। জলাভূমি সুরক্ষায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান স্পষ্টতই বাংলাদেশের তুলনায় এগিয়ে।
দেশে জলাভূমি ও নদী দখলের যে দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে, সেটাকে রীতিমত তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সত্তর ও আশির দশকে বিল শুকিয়ে কৃষিজমিতে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সূচিত জলাভূমি দখল প্রক্রিয়ায় যত দিন গেছে; যুক্ত হয়েছে নদী ও অন্যান্য জলাভূমি। এই দখল সাধারণত চারভাবে ঘটে থাকে-
ক. মনস্তাত্ত্বিকভাবে :নদী বা জলাশয় সম্পর্কে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি করা- দখল ও দূষণ ছাড়া এর আর কোনো উপযোগিতা নেই।
খ. জৈবিকভাবে :কারখানা বা কৃষিজমির রাসায়নিক দূষণের মাধ্যমে নদী ও জলাভূমির মৎস্যসম্পদহীন করে তোলা। সুপেয় বা সেচের পানির উৎস হিসেবে এর উপযোগিতা হ্রাস বা শূন্য করে তোলা।
গ. দৈহিকভাবে :নদী, জলাভূমি বা মাঠ দখল করে, ভরাট করে আবাসিক, বাণিজ্যিক বা শিল্প স্থাপনা, এমনকি কৃষিজমিতে রূপান্তর।
ঘ. ব্যবস্থাপনাগত :নদী ও জলাভূমি দখলের আরেকটি পদ্ধতি সম্ভবত শুধু বাংলাদেশে দেখা যায়- আইন ও নিয়মের অপপ্রয়োগ বা প্রয়োগকারী সংস্থার অপব্যবহারের মাধ্যমে দখলদারিত্বের 'বৈধতা' দেওয়া। যেমন বিল-ঝিল ইজারা; চকিরপশারের মতো নদীকে অবক্ষয়িত জলাশয় দেখিয়ে ইজারা।
নদী ও জলাভূমি দখলের দুষ্টচক্রের আরেকটি 'আদর্শ' উদাহরণ হতে পারে- একটি নদী থেকে বালু তোলার মাধ্যমে সেটার মৎস্যসম্পদ, জল-কাঠামো নষ্ট করা হয়। আবার সেই বালু দিয়ে দখল ও ভরাট করা হয় অন্য কোনো নদী বা জলাভূমি। আবার নদী ও জলাভূমি দখল করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক ভারসাম্য এবং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে।
স্বীকার করতে হবে, নদী ও জলাভূমি রক্ষায় আমাদের এক ধরনের আত্মতুষ্টি রয়েছে। এর কারণ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ১৮/ক ধারা যুক্ত করা হয়েছে। নদী ও জলাভূমি সংরক্ষণের গুরুত্ব বিবেচনা করে গত তিন দশকে বেশ কয়েকটি আইন, নীতিমালা, বিধিমালাও প্রণীত হয়েছে। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা এবং নদীরক্ষা কমিশনকে সব জলাভূমির অভিভাবক ঘোষণা ছাড়াও গত দুই দশকে উচ্চ আদালত বেশ কিছু যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী, জলাভূমি ও পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠছে, শক্তিশালী হচ্ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ফলে পরিবেশবাদীদের পক্ষে তুষ্ট না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে আমরা এই তুষ্টির বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছি। অন্যদিকে নদী ও জলাভূমি দখলদাররা শুধু থেমেই থাকছে না; নতুন নতুন কায়দায় নতুন নতুন ক্ষেত্র দখল করে চলেছে। নদী ও জলাভূমি রক্ষায় সবকিছুর আগে এই তুষ্টবৃত্ত থেকে বের হয়ে আসা জরুরি।
শেখ রোকন: সহযোগী সম্পাদক, সমকাল; মহাসচিব, রিভারাইন পিপল
skrokon@gmail.com
মন্তব্য করুন