- মতামত
- ক্ষমতার দাবিদার সব পক্ষই হোক মুক্তিযুদ্ধপন্থি
রাজনীতি
ক্ষমতার দাবিদার সব পক্ষই হোক মুক্তিযুদ্ধপন্থি

এই দেশ স্বাধীন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সেখানে দুটি পক্ষ ছিল। এক পক্ষ মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে; প্রয়োজনে জীবন দিয়েছে। আরেকটি পক্ষও যুদ্ধ করেছে, তবে পাকিস্তানের পক্ষে। দেশমাতৃকার সঙ্গে বেইমানি করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় হয়েছে চূড়ান্তভাবে। কিন্তু তারা ঘাপটি মেরে রয়ে গেছে আমাদের মধ্যেই। যারা একসময় এ দেশের জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল; বাঙালির মৌল চেতনার বিরোধিতা করেছিল; রক্ত-মাংসে মিশে আছে যাদের পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা; তারা প্রকাশ্য রাজনীতিও করে যাচ্ছে।
সত্য যে, শুভশক্তির সমান্তরালে একটি পরাজিত শক্তি বা প্রগতিবিরোধী শক্তির উপস্থিতিও সর্বদা বিদ্যমান থাকে। এরা পরজীবী উদ্ভিদ রূপে প্রথমে আশ্রয় নেয়, অতঃপর মূলবৃক্ষটিকেই গ্রাস করতে উদ্যত হয়। এ জন্য তা শুরুতেই সমূলে উৎপাটন করা শ্রেয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ফলে এরা ছোবল মেরেছিল কাছ থেকে। শত্রুকে সঙ্গে নিয়ে বসবাসের জন্য বাংলাদেশকে এর কড়া মূল্য দিতে হয়েছে বারবার।
১৯৭৫ সালের কুশীলবরা বঙ্গবন্ধুর আশপাশে অবাধে বিচরণ করার সুযোগ পেয়েছিল। কেন এবং কীভাবে– সে বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে। যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের অনেকেরই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয় ছিল। প্রশ্ন হলো– পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে এটাই সত্য– প্রতিপক্ষ সব সময় অন্য পক্ষের মধ্যেই নিজেদের চর সৃষ্টি করে। সুযোগ বুঝে চূড়ান্ত আঘাত তারাই করে। পলাশীর ক্ষেত্রে তা-ই ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল।
এই আলোকে পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির হাতে চলে যায় রাষ্ট্র। এ কথা বোঝা যায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভাষা থেকে। সেখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক পরিবর্তন’ হিসেবে বলা হয়েছে। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন ও মার্শাল ল জারি করার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের কোনো কোর্ট এমনকি সুপ্রিম কোর্টও কোনো বিচার অথবা কোনো সংস্থা কর্তৃক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগও আনা যাবে না। শেখ মুজিবের চিরশত্রুর কাছেও তো নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীসহ জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মম হত্যা করার ঘটনা ‘ঐতিহাসিক পরিবর্তন’ হতে পারে না। যে কোনো বিচারে সেটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ।
পঁচাত্তরে নীলনকশা বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে আনা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া নিজের অজান্তেই ১৫ আগস্টের অন্তরালের শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যদি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতেন, তবে ইতিহাসে তাঁর স্থান ভিন্ন হতে পারত। বড় কথা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে যেসব ব্যক্তি ও দল স্বাধীন দেশে পরিত্যক্ত হয়ে যায়; জেনারেল জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দলে তারা পুনর্বাসিত হতে থাকে। জেনারেল এরশাদের সময়েও সে ধারা অব্যাহত থাকে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার আত্মস্বীকৃত খুনিরা এরশাদের শাসনামলে ফ্রিডম পার্টি প্রতিষ্ঠা করে। খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে এদের সংসদে বসার সুযোগ করে দেন। এ ছাড়াও খালেদা জিয়ার শাসনামলে সাম্প্রদায়িক, দেশবিরোধী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ওপর প্রকাশ্যে আক্রমণকারীরূপে আবির্ভূত হয় ১৯৭১ সালের মতো। বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর খালেদা জিয়া সরকারের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকরূপে চিহ্নিত হয়। অবশ্য পরে জানা গেল, এ আক্রমণের সঙ্গে সরকারেরই একটা অংশ জড়িয়ে পড়েছিল। কী দুর্ভাগ্য জাতির!
বাম রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ ছিল বাংলাদেশে। কিন্তু এসব দলের একটি অংশ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জেনে-না জেনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছে। অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রগতিশীল অংশটিও এমন সব জটিল আর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। তারা এমন সব কথাবার্তা বলে, জনগণ তার আগামাথা কিছু বোঝে না।
স্বীকার করতে হবে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি করার মতো অনেক এজেন্ডা আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ তৈরি করে দেয়। সেসব কাজে লাগিয়ে জনসমর্থন অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু সেসব দলকে অবধারিতভাবেই বাংলাদেশের পক্ষের দল হতে হবে। ২০১৪ ও ’১৮ সালে অপেক্ষাকৃত কম অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের তেমন মাথাব্যথা না থাকার কারণ কি এই– তাদের হাতে আওয়ামী লীগের বিকল্প মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো রাজনৈতিক শক্তি না থাকা? ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পর বিএনপি দেড় মাসও ক্ষমতায় থাকতে না পারার কারণ কি ঠিক এর উল্টো? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
প্রকাশ্যে বা ঘোমটা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পরিপন্থি কোনো দল বা জোট অথবা জোটের একাংশের পজিশনে বা অপজিশনে আসন পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক পরাজয়ের শামিল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিক মৌসুমি রাজনীতিকের আবির্ভাব। নির্বাচনের আগে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে এ ধরনের রাজনীতিক সক্রিয় হয়। জনগণ চায় রাজনীতি থাকুক পেশাদার রাজনীতিবিদের হাতে। তারা হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী; অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ভাবধারার দেশপ্রেমিক শক্তি।
অধ্যাপক ড. মো. আবদুর রহিম: প্রাধ্যক্ষ, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন