যান্ত্রিক দ্বিচক্রযান তথা মোটরসাইকেল নীতিমালা লইয়া বহুমাত্রিক যে সংকট উদ্ভূত, উহার একমাত্রিক সমাধান সহজ নহে। তজ্জন্য মোটরসাইকেল লইয়া সরকার যে মুশকিলে পড়িয়াছে, বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে উহা স্পষ্ট। একদিকে দেশে উৎপাদন ও সংযোজনের কারণে এই দ্বিচক্রযান সহজলভ্য হইয়া উঠিয়াছে, অপরদিকে উহার বাজারও সম্প্রসারিত হইয়াছে। ইহা ঘিরিয়া দেশের বিভিন্ন জনপদে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাত্রাও নগণ্য নহে। কিন্তু সংখ্যার সহিত পাল্লা দিয়া দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিও বাড়িয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। স্বাভাবিক কারণেই প্রয়োজন হইয়াছে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালার প্রণয়নের। উহার খসড়াও ইতোমধ্যে প্রস্তুত বলিয়া জানা যাইতেছে। আমরা মনে করি, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। কিন্তু এমন কঠোর নীতিমালা সমীচীন হইবে না, যাহাতে ইহার বাজার ও ব্যবহার সংকুচিত হইয়া পড়ে। বস্তুত শুধু এক প্রকার যানবাহন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্ঘটনা হ্রাস পাইবার সুযোগ সামান্য। উহাকে ধন্বন্তরি না ভাবিয়া সড়কপথে সার্বিক শৃঙ্খলা আনয়ন বরং জরুরি।

স্বীকার করিতে হইবে, দেশের সড়কপথে সংঘটিত দুর্ঘটনার অন্তত ৪০ শতাংশ মোটরসাইকেলকেন্দ্রিক। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে দেখা যাইতেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশের বয়স ২১-এর নিচে। ইহার অর্থ, সড়কে নিয়ম মানিয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ যাঁহারা মোটরসাইকেল চালাইয়া থাকেন, তাঁহাদের ক্ষেত্রে শঙ্কা সেই অর্থে কম। তবে মহাসড়কে মোটরসাইকেল যে দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়াইয়া তোলে, তাহা বিশেষজ্ঞরাও বলিয়াছেন। সে বিবেচনায় ‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা-২০২৩’ এর খসড়ায় মহাসড়কে উচ্চ ক্ষমতার ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মোটরসাইকেল উৎপাদনকারীরাও ইতিবাচক হিসাবে লইয়াছেন। তবে তাঁহারা শহরে ৩০ কিলোমিটারের গতিসীমা লইয়া যে আপত্তি তুলিয়াছেন, তাহা সরকার পুনর্বিবেচনা করিতে পারে।

মোটরসাইকেলের বাড়বাড়ন্ত এবং এক যুগে ইহা ছয় গুণ হইয়াছে বলিয়া সমকালের প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে। বিদেশি কোম্পানিগুলির বিনিয়োগের কারণে যদ্রূপ দেশেই মোটরসাইকেল উৎপাদন হইতেছে, তদ্রূপ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলিও মোটরসাইকেল উৎপাদন করিতেছে। তজ্জন্য মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ নীতিমালায় তাহাদের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখিতে হইবে। নতুন নীতিমালায় স্কুটির বিষয়টি বিতর্ক তৈরি করিয়াছে। সরকার স্কুটিকে উৎসাহিত করিলেও এই শিল্প-সংশ্লিষ্টরা মনে করিতেছেন, ইহা অপেক্ষা মোটরসাইকেলই অধিক নিরাপদ। এতদ্ব্যতীত স্কুটি আমদানি করিতে হইলেও মোটরসাইকেল এখানেই উৎপাদন হইতেছে। আমাদের বিশ্বাস, উহা বিবেচনায় রাখিয়াই সরকার নীতিমালাটি পর্যালোচনা করিবে।


মোটরসাইকেল চালক তথা বাইকার অনেকে রাজধানীতে আন্দোলন করিয়া যদিও মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা বাতিলের দাবি জানাইয়াছেন, তথাপি আমরা মনে করি, নীতিমালাটি মোটরসাইকেলে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্যই দরকার। এ শিল্পের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত না করিয়াই সেটা করা সম্ভব। তবে বিনিয়োগ ও উৎপাদনকারীরা মোটরসাইকেল নীতিমালার খসড়ার আগে তাঁহাদের মতামত লওয়া হয় নাই বলিয়া যে অভিযোগ করিয়াছেন, উহা দেখা প্রয়োজন। যে কোনো খাতে নীতিমালা কিংবা আইন প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত লওয়াই প্রত্যাশিত। ইহার ব্যত্যয় ঘটিলে একদিকে যেমন সংশ্লিষ্টরা ক্ষতিগ্রস্ত হইতে পারেন; নীতিমালাটিও অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইতে পারে।

মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত দুর্ঘটনা রোধ। ইহাও বলা প্রয়োজন, সার্বিকভাবে সড়ক নিরাপদ করিবার ক্ষেত্রে শুধু মোটরসাইকেল নয়; অন্যান্য যানবাহনকেও শৃঙ্খলায় আনিতে হইবে। এতদ্ব্যতীত, শুধু আইন বা নীতিমালা করিলেই হইবে না; উহা বাস্তবায়নেও নজর দিতে হইবে। ইতোপূর্বে সড়ক নিরাপত্তা আইন হইলেও উহা পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন না হইবার কারণে সড়কে তাহার ইতিবাচক প্রভাব সেই অর্থে স্পষ্ট হইতেছে না। মোটরসাইকেল নীতিমালার ক্ষেত্রেও একই পরিণতি কাম্য হইতে পারে না। তবে উহার পূর্বে মোটরসাইকেল শিল্প রক্ষা, মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা এবং নিরাপদ সড়ক তৈরি– উভয় কূলই রক্ষা করিবার কঠিন কার্যটি সম্পাদনের বিকল্প নাই।