অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ তিনি। বর্তমানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের ডিন। আছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবেও। জ্বালানি সংকট ও সক্ষমতার বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন সারোয়ার সুমন।

সমকাল: জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি কেমন বলে মনে করেন?

এম শামসুল আলম: জ্বালানি নিয়ে ত্রিমুখী সংকটে আছে বাংলাদেশ। একদিকে জ্বালানির দাম ক্রমশ বাড়ছে, আরেক দিকে সরকারের ভর্তুকি বাড়ছে। এই সংকট মোকাবিলা করার জন্য দরকার গণমুখী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কিন্তু সেখানেও সংকট আছে। দায়িত্বশীল পদে যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। অভাব আছে সততার। অভাব আছে জবাবদিহিতার। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হলে আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি গণশুনানি করত। এখন সেটিও হচ্ছে না। গণমানুষের মতামত না নিয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে সেটি গণমুখী হয় না। তবে এখনও সময় আছে গুরুত্বপূর্ণ এই খাত নিয়ে গভীরভাবে ভাবার। সবাই মিলে এগিয়ে এলে জ্বালানি সংকটও মোকাবিলা করতে পারবে বাংলাদেশ।

সমকাল: দুই মাসের ব্যবধানে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি কতটা অপরিহার্য ছিল?

এম শামসুল আলম: সরকারের নির্বাহী আদেশে দুই মাসের মধ্যে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকে অযৌক্তিক বলে মনে করি আমি। এমন দাম বাড়ায় সবাই বিপর্যয়ে পড়বে। দাম বাড়েত পারে। কিন্তু যেভাবে হচ্ছে সেটা দিয়ে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। দেশে আইন-বিধিমালা রয়েছে। সেটিকে উপেক্ষা করে এভাবে মনগড়া দাম বাড়ানোর এখতিয়ার কারও নেই। যখন-তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, ভর্তুকি সমন্বয় করা– এসব ব্যাপারে আপত্তি আমরা দিয়েছি। জ্বালানি নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে ঊর্ধ্বতনদের।

সমকাল: আন্তর্জাতিক বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম অনেকটা কমে এসেছে। কিন্তু জ্বালানির দাম কমলেও কেন সেই সুবিধা নিতে পারছে না বাংলাদেশ?

এম শামসুল আলম: ভুল নীতির কারণেই আমরা সক্ষমতা বাড়াতে পারছি না। দাম কমার সুবিধাও নিতে পারছি না। আমরা দেশের গ্যাসসম্পদ নতুন করে অনুসন্ধান ও আহরণের চেষ্টা করিনি। একসময় বলা হতো, দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। ২০১৬ সালের পর সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলতে থাকলেন, মাটির নিচে গ্যাস নেই। দুটোই অসত্য। এখনও আমাদের বিদ্যুতের ৬০ শতাংশের বেশি আসে দেশীয় উৎস থেকে। সরকার যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে না। দায়িত্বশীলরা ভোক্তার স্বার্থের কথা না ভেবে রাজস্ব ঘাটতির দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টিকে অনুধাবন করছেন। জ্বালানি সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি এখন অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কারণ খাদ্যের মতো জ্বালানিও এখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ এখন এক থেকে দেড় মাসের জ্বালানি মজুতের সক্ষমতা আছে আমাদের। এটি ন্যূনতম ৯০ দিনে নিতে হবে।

সমকাল: দাম না বাড়িয়ে সংকট মোকাবিলায় বিকল্প কোনো পদ্ধতি আপনার জানা আছে কিনা?

এম শামসুল আলম: জ্বালানি খাতে উন্নয়ন হচ্ছে। তবে সেটি টেকসই  উন্নয়ন  নয়। টেকসই উন্নয়ন হলে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়ই লাভবান হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো ব্যয় বাড়াচ্ছে। আবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বলে দিচ্ছে, এত ভাগ লাভ করতে হবে। এই লাভ ধরতে গেলে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে ভোক্তা দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১০ সালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ করে দেওয়া হলেও সেখানে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার সুযোগ ছিল না। বিশেষ গোষ্ঠী এ সুযোগ পেয়েছে। প্রথমে আইনটি করা হয়েছিল দুই বছরের জন্য। এর পর এটি পাঁচ বছর বাড়ানো হয়। এখন বলা হচ্ছে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এ আইনের প্রয়োজন আছে। পুরো বিষয়টি আসলে হযবরল অবস্থায় আছে।

সমকাল: বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কীভাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারে?

এম শামসুল আলম: বিপিসি এখন আয় ও ব্যয়ের যে হিসাব দিচ্ছে,  তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম অথবা মহাহিসাবরক্ষকের দপ্তরের মাধ্যমে হিসাব নিরীক্ষা করছে না তারা। এখনও সনাতন পদ্ধতিতে তেল পরিমাপ করে তারা। এ কারণে সিস্টেম লস বেশি হচ্ছে। দুর্নীতির সুযোগও তৈরি হচ্ছে। বিপিসিকে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় আনতে হবে। তাদের মজুত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমদানি প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করতে হবে স্বচ্ছতা।