- মতামত
- দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি উদাহরণ
সাক্ষাৎকার: লে. জেনারেল (অব.) অরুণ কুমার সাহনি
দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি উদাহরণ

ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরুণ কুমার সাহনি প্রায় চার দশক বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন ও অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ নিরাপত্তা বিষয়াদি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, সামরিক কূটনীতি প্রভৃতি বিষয়ে কাজ করছেন। সমকালের জন্য তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক অয়নাংশ মৈত্র।
সমকাল: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সশস্ত্র অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট কী ছিল?
অরুণ সাহনি: এ প্রসঙ্গে প্রথমেই স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের জনগণের ত্যাগ, দৃঢ়সংকল্প এবং দৃঢ়তার কথা বলতে হবে। এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। তবে হ্যাঁ, পাকিস্তানি বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে নৃশংসতা ও গণহত্যা চালিয়েছিল, প্রতিবেশী হিসেবে ভারত তা সহ্য করতে পারেনি। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ বাঙালির আহ্বানে ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে সব ধরনের সহায়তার জন্য সব ‘জাতীয় শক্তির উপকরণ’ ব্যবহার করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনী শুধু প্রশিক্ষণই দেয়নি, দক্ষ গেরিলা বাহিনী হিসেবে সংগঠিত করেছিল।
সমকাল: চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় সামরিক বাহিনী সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নেয়।
অরুণ সাহনি: ভারতীয় সেনা অফিসার ও জওয়ানরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। আমরা সেনাবাহিনীর ভাষায় এটাকে বলি ‘অন জব ট্রেনিং’। ডিসেম্বরে এসে ভারতীয় সেনাবাহিনী বহুমুখী আক্রমণ শুরু করে। বিমানবাহিনী আক্রমণের প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের বিমান শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। নৌ অবরোধ, স্থল আক্রমণের সঙ্গে একত্রে, নিশ্চিত করে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সমকাল: যৌথ বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল?
অরুণ সাহনি: আমি মনে করি, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাশিত নৈতিকতা ও জেনেভা কনভেনশনের নীতি প্রতিপালনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিল। আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং সিনিয়র সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে স্থানীয় জনসাধারণের প্রতিশোধ থেকে রক্ষা করেছিল। ঢাকায় ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে কোনো সশস্ত্র বাহিনীর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ। জনসাধারণের ক্ষোভ বা জনরোষ থেকে তাদের রক্ষা করা ছিল যৌথ বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত নবগঠিত বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল যৌথ বাহিনীর দূরদর্শিতার কারণে।
সমকাল: মুক্তিবাহিনী কী ধরনের গেরিলা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল?
অরুণ সাহনি: গেরিলা যুদ্ধের শুরুতে ‘মৌলিক সৈনিক দক্ষতার’ বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন ছিল। যাতে করে মুক্তিবাহিনী শারীরিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে এবং গোপনীয়তার সঙ্গে, নিরাপদে, অল্প সংখ্যায়, যুদ্ধ পরিচালনার মৌলিক কৌশলগত দক্ষতা শিখতে পারে। সবশেষে ছিল ব্যক্তিগত অস্ত্র– রাইফেল, পিস্তল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মতো সৈনিক সহায়তার ব্যবহার করতে হবে। গ্রেনেড ও বেয়নেট চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তার পরে দিন ও রাতে সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগের পদ্ধতি এবং ছদ্মবেশ ও পরিচয় গোপন করার মৌলিক বিষয়গুলো নিয়েও গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকের জন্য কমবেশি তিন মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। সেখানে শত্রুর সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছিল। একই সঙ্গে অ্যামবুশ, শত্রুকে ধাওয়া করা, বিস্ফোরক ও মাইন ব্যবহার, প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
সমকাল: একাত্তরে পাকিস্তানের দিক থেকে কৌশলগত ভুলগুলো কী ছিল?
অরুণ সাহনি: তারা ভারতের কাছ থেকে সামরিকভাবে জোরালো প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করেনি। এ ছাড়া ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালের সামরিক ব্যস্ততার পর তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে নিশ্চিত ছিল। এ ছাড়া তারা মনে করেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিকভাবেও সমর্থন করবে। এগুলো নিশ্চিতভাবে ভুল গণনা ছিল।
সমকাল: আপনি কি মনে করেন, গণহত্যা ও গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইবে?
অরুণ সাহনি: এটা করা নৈতিকভাবে উচিত। কিন্তু আমি মনে করি না যে পাকিস্তানের বর্তমান ব্যবস্থায় এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে কাছাকাছি বা মধ্য মেয়াদে এটি ঘটতে দেখা যাবে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাঙালি জনগণের ওপর যে নৃশংসতা চালিয়েছে, তা সত্যিই যে কোনো সেনাবাহিনীর জন্য লজ্জাজনক। পাকিস্তান নেতৃত্বের যে বিলম্বে হলেও এ জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সমকাল: আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উত্থানকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
অরুণ সাহনি: বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই উদীয়মান ভূরাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত ক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন দেখতে পাওয়া ভারতীয় হিসেবে আমার এবং আমাদের পক্ষে সত্যিই আনন্দদায়ক। বাংলাদেশের এই অগ্রগতি ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও উৎসাহব্যঞ্জক। উদীয়মান বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ অত্যন্ত উদ্ভাবনী ও দেশীয় পদ্ধতির মাধ্যমে যেভাবে তার আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলেছে, তার উদাহরণ খুব বেশি নেই।
সমকাল: ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রশ্নটি বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবিলা করছে?
অরুণ সাহনি: বর্তমানে ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশ সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখছে পরিপক্বতার সঙ্গে; কোনো পক্ষের সঙ্গে কোনো রকম বৈরিতা ছাড়াই। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় এটা সহজ কাজ না। তবে বঙ্গোপসাগর এলাকা যাতে সামরিক দিক থেকে ভারসাম্যহীন না হয়ে পড়ে, সেদিকে বাংলাদেশকে বিশেষ নজর দিতে হবে। আপনাকে মনে রাখতে হবে, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার ক্ষেত্রেও বঙ্গোপসাগর খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আগামী কয়েক দশকে এর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার জন্যও এটি হবে ফ্রন্টলাইন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলছে। জলবায়ু প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য ‘ডেল্টা প্ল্যান-২০২১’ এবং ‘মুজিব প্রসপারিটি প্ল্যান ২০৩০’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি দলিল। এগুলো সত্যিই প্রশংসনীয় এবং এ অঞ্চলের অনেক দেশের জন্য পথপ্রদর্শক।
সমকাল: দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের ভূমিকা ব্যাখ্যা করবেন?
অরুণ সাহনি: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা একে অপরের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, সামাজিক সংহতি এবং আর্থিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা প্রদান এবং বিমসটেক ও বিবিআইএনের মতো আঞ্চলিক গ্রুপগুলো প্রয়োজনীয় গতি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা অনন্য। নেপাল ও ভুটানের মতো স্থলবেষ্টিত দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর জন্য বাংলাদেশ যেভাবে সমুদ্রবন্দর সুবিধার সম্প্রসারণ করে চলছে, তা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য ও উৎপাদন বাড়াবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ ও সংযোগ বৃদ্ধি করবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর একত্রীকরণ সহজতর করবে।
সমকাল: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলতে চান?
অরুণ সাহনি: আমি আন্তরিকভাবে বলতে চাই যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইতিবাচক উদাহরণ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশও অনুসরণ করতে পারে। দুই দেশ যেভাবে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রের দায়িত্বগুলোও সুষমভাবে সম্পন্ন করছে, তা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য উদাহরণ হতে পারে। ভূরাজনীতির জন্য বাংলাদেশ একটি আদর্শ উদাহরণ।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
অরুণ সাহনি: আপনাকে ও সমকালকে স্বাগত।
মন্তব্য করুন